আকাশ ছোঁয়া খেলাপি ঋণ

২০২৪ সাল শেষে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো। গত বছরের আগষ্টের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিনের লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ ও ক্ষতির হিসাব প্রকাশ পেতেই ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা কমে গেছে। এর ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার (সিআরএআর) নেমে আসে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত পরিমাণের অর্ধেকেরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণও হঠাৎ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায়, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি। দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ। এ পরিমাণ ঝুঁকিপূর্ণ মোট ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের সমান প্রায়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। পুন:তফসিলকৃত ঋণ; ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা ও অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে সরকার ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ এবং নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। কিšুÍ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা জাতীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সে কারণে ঋণ খেলাপিরা জাতীয় অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া দেশে ক্রমাগত খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের রেকর্ড হয়েছে।
তথ্য মতে, ডিসেম্বরের প্রান্তিক থেকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২০ দশমিক ২ শতাংশ। আলোচ্য সময় শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এ বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এ তথ্য জানা গেছে। বলা দরকার, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা একে একে খেলাপি হয়ে পড়েছে-যা অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
আমরা মনে করি, এই বাড়তি চাপের বিষয়টি আমলে নিতে হবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গোপন রাখা খেলাপির সঠিক তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নিলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেরিয়ে এসেছে বলে জানা যায়। এর আগে ব্যাংক খাতে সর্বোচ্চ খেলাপি রেকর্ড ছিল সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে।
আরও পড়ুনমনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণ একটি বড় বাধা। জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অংকের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে কলমে কম দেখানো হতো। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফলে আগামী দিনে খেলাপি ঋণ সহ যে কোনো ধরনের অনিয়ম রোধে কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে।
এটিও আলোচনায় এসেছে যে, যতই নতুন তথ্য আসছে ততই বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কর্তৃপক্ষ বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠন করা হবে। যেসব ব্যাংককে একীভূত করার দরকার সেগুলো একীভূত করা অথবা নতুন বিনিয়োগকারী নিয়ে এসে পুনর্গঠন করা হবে। তা ছাড়া আইনগত সংস্কার হচ্ছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন রিভিউ হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বে ব্যাংকিং খাত কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলার অপেক্ষা রাখে না। এই খাতের যে কোনো অনিয়ম দেশের সার্বিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংক খাতের সংস্কার এবং সব ধরনের অনিয়ম রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে যেন কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা বা অনিয়ম না হয় সেটি রোধ করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই।
মন্তব্য করুন