নাটোরে বাঁশি বাজলেই দোকানপাট বন্ধ : মুসলিমরা যান মসজিদে, হিন্দুরা করেন পূজা

নলডাঙ্গা (নাটোর) প্রতিনিধি : ঘড়ির কাটায় ঠিক তখন বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিট। হঠাৎ করে ভেসে আসে বাঁশির আওয়াজ। একদিকে বাঁশির আওয়াজ আর অন্যদিকে বন্ধ হতে থাকে দোকানপাট। মুর্হর্তের মধ্যে দোকানীরা বন্ধ করে দেন তাদের দোকান আর ক্রেতারাও থেমে যান তাদের কেনাকাটায়। কিছুক্ষণ পরেই আবারও ভেসে আসে মাগরিবের আযানের ধ্বনি। ঠিক তখনই মুসলিম ব্যবসায়ীরা যান মসজিদে নামাজ পড়তে আর হিন্দু ধর্মালম্বীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানে সন্ধ্যাবাতি দেয়া ও পূজা-অর্চনায়। ওই সময় বাজারে থাকে না কোন শব্দ। সকলের একতা বদ্ধতা, শৃঙ্খলাই বলে দেয় এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে হিন্দু-মুসলিমের ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির।
গত ২১ বছর ধরে এমন সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের চাঁদপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা। এখানে নেই কোন অনৈক্য বা বিশৃঙ্খল পরিবেশ। সবাই সবার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেন তারা। ধর্ম-বর্ণ সবার ঊর্ধ্বে ওঠে তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির এই চর্চা সত্যিই খুব প্রশংসনীয়।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৪ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহি হালতিবিল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চাঁদপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম এই প্রথা চালু করেন। প্রথম দিকে বাজারের সকলকে নিয়ে তিনি বৈঠক করে এমন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার কথা শোনান। তখনই তারা ঠিক করেন মাগরিবের সময় এক সঙ্গে দোকান বন্ধ রেখে নামাজ আদায় করবেন। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আযানের আগেই আগাম বার্তা হিসেবে বাঁশি বাজানোর। এতে শুধু মুসলিমরাই নয়, হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মালম্বীরাও এতে এক মত পোষণ করেন। বাঁশি বাজানোর সাথে সাথে তারা দোকান বন্ধ করে নামাজে যান মুসলিম ব্যবসায়ীরা আর সন্ধ্যা বাতিসহ পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকেন হিন্দু ধর্মালম্বীরা। পরে যে যার ধর্মরীতি পালন শেষে পুনরায় দোকান চালু করেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান ও তরিকুল ইসলাম জানান, চাঁদপুর বাজারে ১০৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। সারাক্ষণ বাজারটি জমজমাট থাকে। যেখানে দিনের বাণিজ্য, কোলাহল আর ব্যস্ততার শেষে যখন সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে নামতে থাকে, ঠিক তখনই এই বাজারের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাঁশিতে ফুঁ দেন। বাঁশির ধ্বনি শোনামাত্রই ওই বাজারের শতাধিক দোকানদার বন্ধ করে দেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্রেতারাও থেমে যান কেনাকাটা থেকে। এতে কেউই দেরি করেন না, সকলেই ছুটে যান এক ঠিকানায় মসজিদের দিকে, নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর জন্য। আর হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেন দোকানে বসে। এটি দেশের মধ্যে একটি জলন্ত উদাহরণ। তারা আরো জানান, বাজারের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম মিলে মিশে থাকেন প্রতিটি সময়, প্রতিটি বছর। এ বাজারে ধর্মীয় সম্প্রীতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন নজরুল ইসলাম। এ বাঁশির আওয়াজ শুধু নামাজের ডাক নয়, বরং মিলন ও সহাবস্থানেরও প্রতীক বটে, যা যুগযুগ ধরে রাখতে চান এ এলাকার মানুষ। এছাড়া চাঁদপুর বাজারের এই রীতি শুধু একটি প্রথা নয়, এ যেন এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত, যেখানে ধর্ম আর জীবনের বন্ধন মিলে যায় একই সুরে। আর সেই বাঁশির সুর যেন ডাক দেয় ভিন্ন এক আহ্বানে একতা আর ঈমানের বন্ধনে। তারা এ প্রথা চালু রাখতে চান। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের মত উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান।
আরও পড়ুনএলাকাবাসী জানান, শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সাধারণ ক্রেতারা চাঁদপুর বাজারে আসলে বাঁশির আওয়াজ পেলে তারাও ব্যবসায়ীদের সাথে একসঙ্গে মসজিদে যান। নামাজ শেষে আবার দোকান চালু হলে কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরেন তারা। বিষয়টি তাদের খুব ভাল লাগে। সারা দেশে এমন প্রথা চালু হোক এমন প্রত্যাশা তাদের।
চাঁদপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, তিনি গত ২০০৪ সালে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা এখনও অব্যাহত আছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ প্রথা চালু থাকবে। এতে সকলের প্রতি সকলের বিশ্বাস, একতা, শৃঙ্খলা আর পারস্পরিক সর্ম্পক উন্নয়ন হয়েছে। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ তৈরি হয়েছে। তিনি আরো জানান, সময় মত শুধু নামাজ আদায় নয়, বরং এখানে কোন প্রকার জুয়া, তাস খেলা চলে না। কেউ করলে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দাস বলেন, বিষয়টি তার জানা ছিল। সবেমাত্র এ উপজেলায় যোগদান করেছেন। অবশ্যই এটি প্রশংসার দাবীদার।
মন্তব্য করুন