ভিডিও বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

 

আজ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস: দেশে এখনো ৫০ শতাংশ সন্তান  প্রসব হয় বাড়িতেই 

আজ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস: দেশে এখনো ৫০ শতাংশ সন্তান  প্রসব হয় বাড়িতেই  ,ছবি: সংগৃহীত।

স্টাফ রিপোর্টার : প্রথম এবং একমাত্র সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নীলুফা তার চোখের দৃষ্টি প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বেশ কয়েক বছর টানা চিকিৎসার পর ওই নারী কিছুটা দৃষ্টি ফিরে পেলেও আগের মতো আর দেখতে পারেন না। বগুড়া শহরের সূত্রাপুর এলাকার গৃহিনী নিলুফা জানান, তার বাবার বাড়ি নওগাঁর একটি গ্রামে। প্রথম গর্ভধারণের পর বাবা-মা শখ করে গ্রামে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। কেননা সে সময় তাদের এলাকায় একটি প্রথা চালু ছিল, মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে হবে। এ কারণে শ্বশুরবাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও শখ করে বাবার বাড়িতে যান। সেখানে যাওয়ার মাসখানেক না যেতেই একদিন রাত ১১টার দিতে তার প্রসব বেদনা ওঠে। আশেপাশে কোন দাঈ ছিলেন না। তাই তার চাচিসহ কয়েকজন মুরুব্বি বাড়িতে প্রসব করানোর চেষ্টা করেন। প্রায় তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও সন্তান প্রসব করানো সম্ভব হয়নি, এদিকে ধীরে ধীরে তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সে সময় ওই উপজেলার মেডিকেল অফিসার ছিলেন তার এক কাজিন। উপায়ন্তর না পেয়ে রাত প্রায় ৩টার দিকে ভ্যানযোগে ওই উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেক চেষ্টা করে তার সন্তান প্রসব করানো সম্ভব হলেও নিলুফা দুই চোখের দৃষ্টি প্রায় হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। এরপর টানা কয়েক বছর চিকিৎসার পর চোখের দৃষ্টি কিছুটা ফিরে পেলেও আগের মতো আর দেখতে পারেন না। এরপর ভয়ে নিলুফা আর দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার সাহস করেননি।

রত্নার (ছদ্ম নাম) ঘটনা ভিন্ন। কিছুদিন আগের কথা। রত্না তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ নিয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এই সন্তান তার পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু নিয়মিত পিল না খাওয়ার কারণে হুট করেই গর্ভধারণ করেন। বাড়ির পাশের এক দাঈ দিয়ে তাই বাচ্চা নষ্ট করেছে। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর থেকে আর রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। প্রথমে ডাক্তাররা ভাবলেন, হয়তো জরায়ুতে ফুলের অংশ কিছু থেকে গেছে। কিন্তু ডিএন্ডসি করতে গিয়ে বোঝা গেল, ব্লিডিংয়ের কারণ কেবল অবশিষ্ট ফুলের অংশ নয়। অন্য কোন কারণ আছে, যার জন্য কেবল বাইরে নয়, পেটের ভেতরেও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চিকিৎসকরা পেট কেটে ওপেন করে যা দেখলেন, তা কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ। এ জিনিস কেউ দেখেনি। গ্রামের দাঈ কোন এক গাছের ডাল দিয়ে জরায়ু ফুটো করে জরায়ুর সাথে তার আশেপাশে থাকা সমস্ত রক্তনালীও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। কোনভাবেই রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। এদিকে ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে কয়েক ঘন্টা জমে-মানুষে যুদ্ধ চলার পর গাইনি বিশেষজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিলেন, রোগী যেহেতু এমনিতেও খারাপের দিকে যাচ্ছে, একটা রিস্ক নেয়া যাক। জরায়ু ফেলে দেওয়া হল। জরায়ুতে রক্ত সাপ্লাই দেওয়া মূল বড় বড় রক্তনালীগুলো বেঁধে দেওয়া হোক। তাহলে নিচের দিকের রক্তনালীগুলোতে আর রক্ত আসবে না। কঠিন এই সিদ্ধান্তের আশ্চর্যজনক ভালো ফল পাওয়া গেল। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে রত্না বেঁচে গেলেন।

দুটো ঘটনাই কোন গল্প নয়, বাস্তব। অথচ এভাবেই আমাদের দেশের নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে হেলাফেলা করে, আর এভাবেই গ্রাম্য দাঈরা সন্তান প্রসব করানোর সময় গাছের ডাল দিয়ে কিংবা পল্লী চিকিৎসকের মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে বাচ্চা নষ্ট করতে উদ্যত হন। ফলাফল হিসেবে অনেক মায়ের কপালেই জোটে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব। এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন আজও হয়নি। আর এসব নিয়েই আজ পালিত হবে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’। 

স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব, পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা, হাসপাতালগুলোতে ভোগান্তি এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে দেশে এখনো ৫০ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় বাড়িতে। এ মায়েরা গর্ভধারণকালে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পান না। ফলে আশানুরূপ হারে কমছে না মা ও নবজাতক মৃত্যুর হার। অথচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শতভাগ সন্তান প্রসব হাসপাতালে না হলে মাতৃমৃত্যু কমবে না।

এদিকে বগুড়া জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে বগুড়া জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ৭৮টি মাতৃ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ২০২২ সালে ১৯ জন, ২০২৩ সালে ৩৩ জন, ২০২৪ সালে ১৮ জন এবং ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আটজন মারা গেছেন। তবে এই সাড়ে তিন বছরে সবচেয়ে বেশি মাতৃ মৃত্যু ঘটেছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। সরকারি হিসেবেই ওই উপজেলায় ২১ জন নারী মারা গেছেন। অপরদিকে সাড়ে তিন বছরে বগুড়ার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ২০১টি নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মাতৃ মৃত্যুর মতো নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাও সবচে বেশি ঘটেছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। ওই উপজেলায় সাড়ে তিন বছরে ৩৪টি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। 

আরও পড়ুন

বগুড়া জেলা সিভিল সার্জন ডা. একেএম মোফাখখারুল ইসলাম জানান, যে এলাকায় বাড়িতে প্রসব করানোর হার বেশি সেসব এলাকায় মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হারও বেশি। বাড়িতে যেন সন্তান প্রসব না করানো হয় এজন্য আমরা সচেতনতা বাড়াতে মা সমাবেশসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম করে থাকি। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নের রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। গর্ভবতী নারীরা ওইসব ক্লিনিক থেকে সেবা নিতে পারেন। 

অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) বগুড়ার যুগ্ম সম্পাদক বিশিষ্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা জানান, একজন নারীকে সন্তান গর্ভধারণের আগে থেকে প্রসব পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়। এসময় জটিলতা তৈরির শঙ্কা বেশি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই মাতৃত্বকালীন সেবা আটবার দেওয়ার পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশে সেটি চারবার করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক নারী এই চারবারের সেবাও গ্রহণ করছেন না। যার কারণে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। 

 

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বগুড়ার গাবতলী দুর্গাহাটা কলেজের অধ্যক্ষকে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা

কাল থেকে সারাদেশে সকল জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান খোলা: বাজুস

বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল রাখায় রাইচ মিলের জরিমানা

জি এম কাদেরের রংপুরের বাসায় হামলা

দিনাজপুরের বীরগঞ্জে শিশু শিক্ষার্থীদের ছাতা উপহার

ধামরাইয়ে ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে ৩৬ লাখ টাকা ছিনতাই