ভিডিও বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

আমার নূপুরের ধ্বনি, ছড়াক মানবতার বাণী

আমার নূপুরের ধ্বনি, ছড়াক মানবতার বাণী। ছবি : দৈনিক করতোয়া

আজ ২৯ এপ্রিল বিশ্ব নৃত্য দিবস, এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই মহান নৃত্য শিল্পী জ্যাঁ জর্জেস নভেরা যার নামে এই দিনটি বিশ্বের সকল নৃত্যশিল্পীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্যান্স এবং গোটা ইউরোপে নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের দুঃখ দুর্দশার চিত্র নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। তার জন্ম ১৭২৭ সালে ২৯ এপ্রিল প্যারিস। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর নভেরার অনুভুতিকে অনুসরণ করে ১৯৮২ সালে তারই জন্ম দিন ২৯ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো এই শিল্পীকে মহান করেছে। আজকের এই দিনে সকল নৃত্য শিল্পীদের জানাই আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের শুভেচ্ছা। 
নৃত্য কলা একটি দৃশ্যমান শিল্পকলা, যা মানুষের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও ভিতরের ভাব রসের সম্মিলিত প্রয়াসে মুদ্রা, তাল ও ছন্দের সমন্বয়ে দৃশ্য কাব্য রচনার মাধ্যমে কোন কিছু প্রকাশ করে। ধর্ম, জীবন, জীবিকা, নান্দনিকতা, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রভাব আছে এ শিল্পের প্রকাশে। এর ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলছে।

মানুষের ভাষা আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই নৃত্যকলা প্রচলনের বহু তথ্য আমরা ভারতীয় ও মিশরীয় গুহাচিত্রে দেখতে পাই। নৃত্য কলা একটি গুরুমুখি বিদ্যা বা ঘরনা নির্ভর শিল্প। ওস্তাদ বা গুরুজী সম্বোধন হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে, গুরু শিষ্যের এ পরম্পরা। সে পথেই আলো ছড়িয়েছেন আমাদের দেশের নৃত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা।

তাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে নৃত্যাঙ্গন। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মরহুম বুলবুল চৌধুরী, মরহুম গওহর জামিল, মরহুম রওশন জামিল, মরহুম সাহেদ আলতামাস, মরহুম রাইজা খানম ঝুনু মরহুম বজলুর রহমান বাদল, মরহুম আব্দুস সামাদ পলাশ সহ যে সকল নৃত্য গুরুরা না ফেরার দেশে চলে গেছেন এবং বর্তমানে যে সকল নৃত্যগুরুরা রয়েছেন তাদের কেউ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম পন্থা নাচ এর উদ্ভব যে বহু আগের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নৃত্য আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলার নৃত্য নিয়ে আমরা রীতিমতো গর্ব করি। বহির্বিশ্বে বাংলায় আদি লোক নৃত্য পরিবেশন করে এই দেশের নৃত্য শিল্পীরা বাংলার নৃত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সংস্কৃতি মনা আমাদের এ জাতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বহির্বিশ্বের মঞ্চে সুনামের সহিত পরিবেশন করেছে এদেশের নৃত্য শিল্পীরা।

আমাদের সংস্কৃতিতে ঠিক কবে থেকে নৃত্যের আবির্ভাব ঘটেছে তা সুস্পষ্ট নয়। তবে নৃত্যে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। স্বাধীনতাত্তোর এদেশে নৃত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ঠিক সে সময় থেকে এদেশের নৃত্য বিশ্বের দরবারে নিজের একটি শক্ত অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে। ধ্রুপদি নৃত্যের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি উত্তরণ ঘটে এ দেশীয় লোক নৃত্য ও গীতি নৃত্য নাট্যের।

এ নৃত্য ধারা দিয়ে এ দেশের নৃত্য শিল্পীরা  বিদেশে নৃত্য পরিবেশন করে বাংলার সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল করেছে। এক্ষেত্রে অগ্রজ নৃত্য গুরুরা আমাদের  যে নৃত্য শিল্পের পথ দেখিয়েছেন তাদের পথ দেখাতেই আমরা নৃত্য কর্মীরা এই শিল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

এ দেশের শিল্প সং¯কৃতির অন্যতম ধারক নৃত্য। সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। তবে প্রয়োজন কিছু সৃজনশীল পদক্ষেপের। তাহলে এ শিল্পকে অন্যতম একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া স¤ভব। আমরা যদি আমাদের অগ্রজ নৃত্যগুরুদের সৃষ্টিশীল কাজগুলো অবলোকন করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে কত নান্দনিক উপস্থাপনা ছিল।

আমরা যদি গুরুদের কথা মত গুরুদের আদর্শ বুকে ধারণ করে সততা ও আদর্শ নিয়ে থাকতে পারি, তাহলে অগ্রজ নৃত্যগুরুদের সৃষ্টিশীল কাজগুলো আমাদের শিরা উপশিরায় ধাবিত হবে। আমাদের অগ্রজ নৃত্য গুরুদের সৃষ্টিশীল কাজ যদি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে আমরা সহ পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সৃষ্টিশীল কাজ জানতে পারবে এবং বুকে ধারণ করে ও লালন করতে পারব।

তাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কাছে বিনীত অনুরোধ আমাদের অগ্রজ নৃত্য গুরুরা যারা না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদের সৃষ্টিশীল কাজগুলো সংরক্ষণ করা এবং বর্তমানে যে সকল নৃত্য গুরুরা বেঁচে আছেন তাদেরও সৃষ্টিশীল কাজগুলো সংরক্ষণ করে রাখা যায় যাতে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম সকল নৃত্য গুরুর সৃষ্টিশীল কাজ সম্বন্ধে জানতে পারে।

আরও পড়ুন

আমাদের দেশে প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে, বয়স বাড়লে শিল্পীর জীবন শেষ হয়ে যায় এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সময় চর্চা, অভিজ্ঞতা, বোধ উপলব্ধি, যত ঋদ্ধ হবে নৃত্যের অভিব্যক্তি ও তত সুন্দর হবে। আমাদের দেশের দর্শক, সরকার সহ সবাইকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।

তাহলেই নৃত্য শিল্পের উন্নতি হবে এবং নৃত্য শিল্পীও সম্মান ও মর্যাদা ফিরে পাবে। আইটি আই ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কমিটি ১৯৮২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন শুরু করে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন করে থাকে বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা সহ অন্যান্য নৃত্য সংগঠন।

পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যে যেখানে নৃত্যের চর্চা নেই, আদিম, প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান কাল অবধি প্রতিটি দেশেই নৃত্যের চর্চার প্রচলন রয়েছে। নৃত্যের উৎপত্তি প্রকৃতি থেকে। যখন মানুষের মুখের কোন ভাষা ছিলনা শুধু অঙ্গ ভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতো; এভাবেই তাদের আবেগ, আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রেম ভালোবাসা অনুভূতি প্রকাশ করতো। সভ্যতার বিবর্তনে দেখা যায় যে প্রতিটি দেশের মানুষ নিজস্ব আঙ্গিকে নৃত্যকে সুষমান্ডিত করেছে তাই নৃত্যকে অঙ্গ ভঙ্গির ভাষা বলা হয়।

আনন্দ, উল্লাস, প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে নিজেদের ভাব প্রকাশের একটা বলিষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে নৃত্য। আজকের এই দিনে যারা নৃত্যের সৌন্দর্য ও এর অন্তর্নিহিত শক্তিকে বুঝতে পেরেছেন, ভালোবেসেছেন তাদের সবার জন্য আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে শুভেচ্ছা রইল।

পরিশেষে আমরা যারা এই শিল্প নিয়ে কাজ করছি আমাদের সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে বাংলাদেশের সকল অগ্রজ নৃত্যগুরুদেরকে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়াত সকল নৃত্যগুরু সহ সকল নৃত্যগুরুর প্রতি আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আপনারা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আপনারা এই নৃত্য শিল্পের বাতিঘর। আপনাদের সৃষ্টিশীল কাজে আলোকিত হয়েছে নৃত্য শিল্প আর সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সকলকে নূপুরের শুভেচ্ছা।

 

মো: মাহাবুব হাসান সোহাগ
লেখক : নৃত্য শিল্পী, নৃত্য পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক, 
আমরা ক’জন শিল্পী গোষ্ঠী, বগুড়া।
বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা, বগুড়া জেলা শাখা
০১৭১২-০৯৫৫১০
তথ্য সূত্র: প্রবেশীকা নৃতী।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি এ দেশের খেটে খাওয়া মাটি ও মানুষের দল - আহসানুল তৈয়ব জাকির

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চীনা রাষ্ট্রদূত বাগান পরিদর্শন করে আম আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন

রাজশাহী এলজিইডিতে একজনের কাজ করে অন্যজন, ব্যবস্থা নেবে দুদক

জাবি আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় স: আ: হক কলেজের সাফল্য

বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থানে করতোয়া নদী থেকে অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার

বগুড়ায় মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত স্কুল ছাত্র উদ্ধার : নারী গ্রেফতার