আজ পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস

পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : আজ ১৫ ডিসেম্বর। বিগত ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ দিনে দিনাজপুরের পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত হয়। পার্বতীপুরের শান্তিকামী মানুষ ৭ মার্চের ভাষণের পর সারা দেশের মত পার্বতীপুরেও শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন।
ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ট্রেন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২৩ মার্চ শহরের অবাঙালিদের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ শহর ঘেরাও করে সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করে।
এ সময় অবাঙালিরা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ব্যাপক গুলি চালিয়ে যাদের হত্যা করে তাদের মধ্যে ২৪ ও ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীসহ ১১ জন, ব্যবসায়ী ৪ জন, কাশিয়া তেলির পরিবারের ৪ সদস্য, তৎকালীন সিনেমা হলের ম্যানেজারের পরিবার, ওয়াহিদ কোম্পানির দু’জন কর্মচারী, পার্বতীপুর থানার এ এস আই গোলাম মোস্তফার পরিবারের সকল সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের পুত্র ডাঃ সামসাদসহ অনেক লোককে কয়লার ইঞ্জিনের বয়লারে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
এ গণহত্যার পর বাঙালিরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ২৬ মার্চ দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত ট্রেনিং না থাকায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, যুবরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এরপর আড়াইশ’ তৎকালীন বেঙ্গল রেজেমেন্ট পুলিশ আর আনসার বাহিনীর সদস্য এসে তাঁবু ফেলে খোলাহাটী আটরাই গ্রামে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার।
ড. আব্দুল বারী ও আব্দুল মতিনের বাড়ি এবং তৎসংলগ্ন এলাকা তারা ব্যবহার করে। তারা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সংগ্রামী দল গঠন করে। এদের হাতে ধরা পড়ে এক অবাঙালি এসপি ও দুই ট্রাক চালক। পরে তাদের হত্যা করা হয়। ২৮ মার্চ একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধীনে ক’জন বাঙালি সৈন্য হুগলীপাড়ার সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর) চত্ত্বরে পাহারা দিচ্ছিল।
দ্বিতল ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙালিদের তৎপরতা লক্ষ্য করে ওয়ারলেসে খবর দেয়ার সময় বাঙালি সেনারা তাকে হত্যা করে। এ ঘটনা জানতে পেরে হানাদাররা হুগলিপাড়ার ছাত্র আব্দুল লতিফকে র্নিমমভাবে হত্যা করে রেলইঞ্জিনের বয়লারে পুড়িয়ে মারে। ১ এপ্রিল সশস্ত্র বাহিনী ও স্থানীয় যুবকদল সন্ধ্যা থেকে শহরের চারিদিকে অবস্থান নেয়। মর্টার লাঞ্চার বসানো হয় বৃত্তিপাড়ায়।
আরও পড়ুনহলদীবাড়ীতে একটি সশস্ত্র দল মোতায়েন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের লোকজন মাঠে, দা, বল্ল¬ম নিয়ে শহরের বাইরে সমবেত হতে থাকে। ভোর ৬ টায় তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। প্রচন্ড শব্দে প্রথম সেল নিক্ষিপ্ত হয় শহরের শোয়েব বিল্ডিং (বর্তমানে পৌরসভা) এর ওপর এবং তা ভেঙে যায়। এভাবে বেশ কয়েকটি সেল পার্বতীপুরের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানার পর অবাঙালিদের গুলি বর্ষণ থেমে যায়। বাঙালিরা সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ঢুকে যায় শহরে।
২ এপ্রিল বাঙালিরা মুক্তিযোদ্ধাদের পার্বতীপুর আক্রমনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পাক সেনারা ও তাদের সহচর অবাঙালি বিহারী, পেশোয়ারী, ইরানী ও অন্যান্য উর্দুভাষীরা হিংস হয়ে ওঠে। তারা পার্বতীপুর শহরের ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায়। মেয়েদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। এছাড়াও অনেক নির্মম নির্যাতনের ঘটনা অজানা রয়েছে।
এমনিভাবে নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে ১৫ডিসেম্বর মুক্তিযাদ্ধা ও শ’ শ’ লোকজন পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে এবং শোয়েব ভবনসহ (সাবেক পৌরসভা ভবন) বড় বড় ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বিজয়োল্লাস শুরু করে।
আজকের এ দিনে পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত হয়। দীর্ঘদিন পর পার্বতীপুরের বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও পরিচর্যার অভাবে এখন তা গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ডিসেম্বর মাস এলেই বধ্যভূমির খোঁজ নেয়া হয় (সংক্ষিপ্ত)।
মন্তব্য করুন