এ সময়ের ভার্চুয়াল দুনিয়া

রায়হান আহমেদ তপাদার: সাম্প্রতিক সময়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেলেও এ ধারণা মোটেও নতুন নয়। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা মর্টন হেলিগ সেনসোরামা নামের একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যাতে চেয়ারে বসে পর্দার ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যেত, সেই সঙ্গে কম্পনের মাধ্যমে অনুভূতি এবং গন্ধ পাওয়া যেত। বড়সড় আকারের হওয়ায় ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যন্ত্রটি সুবিধাজনক ছিল না। মাথায় পরার মতো ছোট ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যন্ত্র ১৯৬৮ সালে প্রথম তৈরি করেন মার্কিন বিজ্ঞানী আইভান সাদারল্যান্ড। এরপরে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার একতরফাভাবে সামরিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের কাজে দেখা যায়। লড়াইয়ের কৌশল কিংবা বিমান বা জাহাজ চালনা শেখার ক্ষেত্রে এটি ভালো ফল দেওয়া শুরু করে। মজার ব্যাপার, তখনো কিন্তু ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ নামটাই চালু হয়নি। আশির দশকে মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জ্যারন ল্যানিয়ার প্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দযুগলের প্রচলন শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকে কিছু যন্ত্র তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এরপর তা নিয়ে আলোচনা একরকম থেমে যায়। এর স্বপ্নদ্রষ্টারা যে কাজের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা একরকম দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল সে সময়ে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম বিজ্ঞান নির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কল্পনার জগতে বাস্তবতা বলে। এভাবেও বলা যায়, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো সফটওয়্যার নির্মিত একটি কাল্পনিক পরিবেশ, যা ব্যবহারকারীর কাছে বাস্তব জগৎ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে মানুষ যা দেখে তা অনুভব করতে পারে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে সৃষ্ট পরিবেশ পুরোপুরি বাস্তব পৃথিবীর মতো মনে হতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার সম্পূর্ণ কম্পিউটিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রিত। কল্পনার জগতটাকে যেন হুবহু বাস্তব মনে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় অপ্রকৃত বাস্তবতা থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাজ করে মূলত দুটি ধাপে। প্রথমে কম্পিউটারে তৈরি ত্রিমাত্রিক ছবি দিয়ে ভার্চুয়াল পরিম ল বানানো হয়। পরের ধাপে ব্যবহারকারীর গতিবিধি অনুসরণ করে ত্রিমাত্রিক ছবি সে অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হয়। আপনি ডান দিকে তাকালে ডান দিকের ছবি দেখাবে, গেমে শত্রু সামনে এলে প্রয়োজন অনুযায়ী হাত নেড়ে তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এই নাড়াচড়াগুলো অনুসরণ করার জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়। ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার জন্য লেন্সসহ হেডসেট ব্যবহার করা হয়, যা একই সঙ্গে চোখের গতিবিধির হিসাব রাখে। আজকের ভার্চুয়াল অ্যাপ্লিকেশনগুলো ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করে ব্যবহারকারীর চারপাশে উপস্থিত হওয়ার অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করতে ব্যবহারকারীর দর্শন ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে এটি ভার্চুয়াল জগতকে ব্যবহারকারীর কাছে পুরোপুরি বাস্তব হিসেবে উপস্থাপন করে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে প্রযুক্তির দুনিয়ায়। আজ যেটা কাল্পনিক, কাল সেটিকেই বাস্তবে পরিণত করছে প্রযুক্তি। আর এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে- ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে।
কয়েক বছরের মধ্যে অভূতপূর্ব গতিতে ভার্চুয়াল জগতকে বাস্তব করে তোলার এ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা, রোগ নিরাময় ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্পর্শ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক স্টার্টআপ ও প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে প্যাকেজ অভিজ্ঞতা ও পরিষেবা সরবরাহ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কিছু ‘ফিচার’ তৈরি করেছে। বর্তমানে ফেসবুক, এইচটিসি ও ইউরোপীয় কমিশনের দূরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রমে এঙ্গেজ (ভিআর) প্লাটফর্ম ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভিআর ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত মেডিকেল শিক্ষার্থীরা সাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত সমবয়সীদের চেয়ে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় দ্রুত এবং আরো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। ভিআরের সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় পাঠদান ও শেখার বিষয়গুলো আরো কার্যকর হয়ে উঠবে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ভিআর ঝামেলাপূর্ণ ও চাপযুক্ত অবস্থা সীমিত করতে এবং অংশগ্রহণকারীর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন উৎসব মৌসুমে যখন গ্রাহকের ভিড় থাকে সেই পরিবেশ মোকাবিলা করে কীভাবে কাজ করা যায়- তা নিয়ে ওয়ালমার্ট ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। করোনা মহামারী কাজের ধরন বদলে দেয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে। বাড়ি থেকে কাজ ও দলভিত্তিক কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভিআর প্রযুক্তিকে ব্যাপক সম্ভাবনাময় হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন একটি টুল তৈরি করেছে স্পটিয়াল, যেটিকে তারা জুমের ভিআর সংস্করণ বলে বর্ণনা করছে। সংস্থাটি গত বছরের মার্চ থেকে প্ল্যাটফর্মটির ব্যবহার ১ হাজার শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে। গত বছর লকডাউন চলাকালীন বাড়ি থেকে কর্মরত কর্মীদের ওকুলাস ভিআর সরবরাহ করেছিল যোগাযোগ জায়ান্ট এরিকসন। সংস্থাটি ইন্টারনেট অব সেন্সেস নিয়ে কাজ করার বিষয়টি জানিয়েছে। এর মধ্যে স্পর্শ, স্বাদ, ঘ্রাণ এবং গরম ও ঠা ার মতো সংবেদনগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি আদান-প্রদান সম্ভব হবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ভিআরভিত্তিক সামাজিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে ভিআর চ্যাট, অলটারস্পেস ভিআর ও রিক রুমের মতো ভার্চুয়াল পরিবেশে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করা ও খেলা যায়। নতুন প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে আগামী বছরগুলোতে এ প্রযুক্তি মূলধারার গ্রাহকদের কাছে আরো কার্যকর ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বৈকি। গত বছর ফেসবুকের সিস্টার প্রতিষ্ঠান ভিআর হেডসেট প্রস্তুতকারক ওকুলাস ফেসবুক হরাইজন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম উন্মোচন করেছে। ফলে আগামীতে ফেসবুকে ভিআর প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বর্তমানে বেটা সংস্করণে মানুষ সহযোগী অনলাইন জগৎ তৈরি ও শেয়ার করতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা গেম খেলা ছাড়াও সহযোগী প্রকল্পগুলোতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
এছাড়া বিনোদনের জন্যও ভিআর বিশাল বাজার তৈরি করছে। যদিও সর্বাধিক ইমারসিভ ও চিত্তাকর্ষক প্রযুক্তি এখনো প্রচুর ব্যয়বহুল এবং এটি পরিচালনার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন। তবুও ঘরে বসে কিছুটা কম চিত্তাকর্ষক হলেও এ অভিজ্ঞতা দর্শকদের নতুন এক চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ব্যথা নিরাময়ে কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত। পাশাপাশি এ প্রযুক্তিগত চিকিৎসা রোগীদের হাসপাতালে থাকার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত এবং চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে দেয়। এরই মধ্যে এ সম্পর্কিত অসংখ্য সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে, যা রোগীদের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে। ইমারসিভ ভিআর প্রযুক্তি গতি ও ভিজ্যুয়াল ভিত্তিক অভিজ্ঞতা সরবরাহ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা দূর করতে সহায়তা করে। রোগীর চাপ ও উদ্বেগের বিষয় বোঝার মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কার্যকর ওষুধ ছাড়া সমাধান দেয়। যেখানে প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না। এছাড়া এটি আলঝেইমারের মতো স্মৃতিশক্তি হ্রাসের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে সহায়তা করে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, আগামী কয়েক বছরে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং মিক্সড রিয়েলিটির সম্মিলিত রূপ এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি মোড় ঘোরানো টেক ট্রেন্ডে পরিণত হবে। এত দিন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কেন্দ্রে ছিল গেমিংশিল্প। কিন্তু ফেসবুকের ওকুলাস ভিআর ক্রয়ে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করেছে।
বিশ্বের নানা প্রান্তের শিক্ষক-ছাত্রের সঙ্গে একই শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ সম্ভব। আর এসব করা যাবে ঘরে বসেই, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে। বাস্তবে নয়, তবে বাস্তবের মতো করেই। গত ২৬ মার্চে ওকুলাস ভিআর ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেয় ফেসবুক। এরপরই সবাই নড়েচড়ে বসে। ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগ রক্ষাটা কি তবে ভার্চুয়াল জগতে হবে, এমন প্রশ্নে প্রযুক্তিবিশ্ব মুখর হয়ে ওঠে। বাস্তব জীবনে অধিকাংশ জিনিসেরই মতো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কিছু মন্দ দিকও এখন সামনে আসছে। যেসব ব্যক্তি এসব ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে নেতিবাচক পরিবেশের মাঝে সময় কাটাচ্ছেন বা বিনোদন খুঁজছেন, তাদের বাস্তব জীবনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাইবার এডিকশনের মাত্রা বাড়াচ্ছে। খুন, সহিংসতা, যৌনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের বাস্তব জগতে নানা আইনের বেড়াজালে বন্দি হলেও, কাল্পনিক জগতে এরা সহজলভ্য। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কাল্পনিক জগতে এসব পরিস্থিতিতে একজন মানুষ বাস্তব জীবনের মতোই স্নায়ুবিক ও শারীরিক অনুভূতির স্বাদ পান। ফলে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আমাদের মনুষ্যত্ব বোধকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না, মনোবিদরা সেটিও ভেবে দেখতে বলেছেন প্রযুক্তিবিদদের। তবে, যেহেতু কোনো শঙ্কাই আজ পর্যন্ত নতুন প্রযুক্তিকে মানুষের হাতের মুঠোয় আসা থামাতে পারেনি। বুদ্ধিমান মানুষও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিবাচক দিক গুলো নিয়ে আরও এগিয়ে যাবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]