ঢাকার চারপাশরে নদী রক্ষা করা দরকার

মীর আব্দুল আলীম : জলে, মলে, শিল্পবর্জ্যে একাকার ঢাকার চারপাশের নদী। নদীর পানি হয়ে উঠেছে ব্যবহার অনুপযোগী। পানিতে অক্সিজেন কমে গেছে। জলজ প্রাণী মরে বিলীন প্রায়। দুর্গন্ধে তীরবর্তী মানুষের বসবাস দায় হয়ে পড়েছে। ঢাকার চারপাশের চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর বালু নদীর এখন এ অবস্থা। অথচ এই নদীগুলো ঢাকার প্রাণ। দূষণ দখলের কবলে থেকে রাজধানীর কোল ঘেঁষা নদীগুলোকে আর বাঁচানো যাচ্ছে না।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ঢাকার চারপাশের নদীর তীরে তিনশ’র বেশি উৎসমুখ বা ড্রেন দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩ লাখ কেজি বর্জ্য পড়ে দূষিত হচ্ছে পানি। নদীর পানির দুর্গন্ধে দূষিত হচ্ছে তীরের প্রকৃতি। অথচ এক সময় এই ৫টি নদী ঢাকা ও আশপাশ জেলার প্রকৃতি-পরিবেশ, নদী তীরবর্তী কৃষি ও মানুষের জন্য ছিল বড় অবলম্বন। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, সরকারিভাবে নদী দূষণের ১৮৫টি উৎসমুখ চিহ্নিত করলেও বেসরকারি মতে তা তিনশ’র বেশি। নদীর তীরে ছোট-বড় প্রায় ৭ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কেজি বা ৩৫০ টন বিষাক্ত বর্জ্য পড়ে নদীর পানিতে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিল্প বর্জ্য, ৩০ শতাংশ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও ইউনিয়ন পরিষদের ড্রেনের বর্জ্য, বাকি ১০ শতাংশ গৃহস্থালি ও অন্যান্য বর্জ্য। এর ফলে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। বিষাক্ত পানির কারণে মাছ ও পোকামাকড়সহ কোন প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারছে না।
দূষণের ফলে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রং হারিয়ে ফেলেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি। কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট এলাকায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২৪ মিলিগ্রাম, ধোলাইখালের ফরিদাবাদ এলাকায় আছে শূন্য দশমিক ৭৯ মিলিগ্রাম, শ্যামপুর খালের মুখে আছে শূন্য দশমিক ৯৮ মিলিগ্রাম, পাগলা ওয়াসা ট্রিটমেন্ট প্লান্টে নির্গত ড্রেনের ভাটিতে অক্সিজেন আছে শূন্য দশমিক ৫৬ মিলিগ্রাম, পাগলার এলাকায় আছে শূন্য দশমিক ৬৩ মিলিগ্রাম, মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে অক্সিজেন আছে শূন্য দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম।
সরকারী সংস্থাগুলোর ড্রেন সরাসরি নদী কিংবা খালে সংযুক্ত হয় তাই দুষণ রোধ হচ্ছে না। কোন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নদী দূষণ হয় এটা আমাদের জানা নেই। এসব উৎসমুখ বন্ধ করতে ২০০৯ সালে তৎকালীন নৌ মন্ত্রীকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল টাস্কফোর্স কমিটি। বর্তমানেও টাস্কফোর্স কমিটি সচল আছে। কিন্তু ১২ বছর বা একযুগেও উৎসমুখ বন্ধের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারিভাবে দূষণ হলে সিদ্ধান্ত কে নেবে? তাই কমিটি ও টাস্কফোর্সের মধ্যে আটকে আছে নদী দূষণমুক্ত করার কাজ। নদী দূষণ প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা।
শীতলক্ষ্যা নদীর সৈয়দপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া পর্যন্ত ৭০টি উৎসমুখ দিয়ে বর্জ্য নদীতে পড়ছে।
এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে এসডি ফ্লাওয়ার মিল, সৈয়দপুরে পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে প্রিমিয়াম সিমেন্ট, শাহ সিমেন্ট, মেট্রোপলিটন সিমেন্ট, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, র্যাক্স নিটওয়্যার, অলরাউন্ড নিটওয়্যার, সোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস, প্রীতম ফ্যাশন, ইব্রাহিম টেক্সটাইল, আদমজী ইপিজেড, স্টার পার্টিকেল বোর্ড, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, কাঁচপুর ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, ডেমরার বেঙ্গল প্যাকেজেস ও মীর সিমেন্টের ড্রেন উল্লেখযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠান ড্রেন ও পাইপের মাধ্যমে শিল্প এবং প্রতিদিনের বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে নদী দূষণ করছে। ৮৭টি উৎসমুখ দিয়ে সারফেস ড্রেন, পাইপ ও অন্যান্য মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে তুরাগ নদী। এরমধ্যে কামারপাড়ায় কংক্রিট রেডিমিক্স, নিশাদনগরে ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, টঙ্গী বাজার, বেঙ্গল ডাইং অ্যান্ড নিটিং, আইচি হাসপাতাল, আজমিরী গার্মেন্টস, বিসিক, ঢাকা ডাইং, মার্চেন্ট ডাইং, মেহমুদ হোসেন ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড, সার্ফ ফিটিং ওয়াশিং প্লান্ট ও প্যারাডাইস ওয়াশিং প্লান্টের ড্রেন। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ’র ঢাকা নদীবন্দর থেকে ১৮৫টি উৎসমুখ চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব উৎসমুখের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি বিআইডব্লিউটিএ।
প্রতিদিনই দূষণ বাড়ছে; বাড়ছে দখলদারদের সংখ্যাও। রাজধানী ঢাকার পরিবেষ্টিত নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার শত চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, র্যালি কোন কিছুই আর কাজে আসছে না। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ,আরা বালু নদী নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে, টেলিভিশনেও সংবাদ সম্প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু কোনই পরিবর্তন নেই। শংকার কথা এই যে, রাজধানীর কোল ঘেঁষা এসব নদী না বাঁচানো গেলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। মানুষ আক্রান্ত হবে নানা রোগ ব্যধিতে। এখনই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রতিটি সরকারই আশ্বাস দিয়েছে অবৈধ দখল মুক্ত এবং নদীর দূষণ দূর করে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো হবে বলে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। রাখবে বলেও মনে হয় না। নদী পারাপার হতে যে কাউকেই নাকে রুমাল চেপে রাখতে হয়। দূষিত পানির তীব্র গন্ধে পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। শীতলক্ষা আর বালু নদীর পানিকে পানি বলে মনে হয় না। মনে হয় পোড়া মবিল। এর ওপর দিয়ে মাঝি তার নৌকা বাইছেন। দূষিত হতে হতে পানি তার স্বাভাবিক ঘনত্বটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে অনেক আগে থেকেই মাছ নেই এ নদীতে। মাছ থাকার মতো অবস্থা নেই নদীর পানির। মরা শীতলক্ষার পানি এখন এত ঘন যে, কোন পানি ছাঁকার ছাঁকনি দিয়ে তা পরবে কি না সন্দেহ আছে। নদীগুলো এখন শিল্পপতি আর ঢাকা শহরের সভ্য মানুষের বিলাসী জীবনের বর্জ্য ফেলার ভাঁগাড়।
দেখা গেছে প্রতি ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মিরা জড়িত এবং সাধারণ মানুষ ও নদী ক্ষতির শিকার। ক্ষমতা বদলের পালায় বরাবরই ক্ষমতাশীনদের যাতাকলে নদীগুলো নিষ্পেষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগসহ সারাদেশের নদী ভরাট, স্থাপনা তৈরি এবং নদীর তীরে বা অংশে ইট, বালু, পাথর, বাঁশ প্রভৃতি ব্যবসার ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তার পরোয়া করছেন না ব্যবসায়ীরা। আদালতের কাজ আদালত করেছেন, দখলদার করছে দখলের কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সরকার কার হয়ে কাজ করছে; চোরের না সাধুর?
ঢাকার চারপাশের চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার দূষণ ও নদীর ভেতরে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে উচ্চ আদালতে একটি জনস্বার্থমূলক রিট মামলা দায়ের করেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। এর রায়ে ঢাকার চার নদী রক্ষায় নয়টি নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে: সিএস ও আরএস মানচিত্র অনুসারে ঢাকার চারটি নদীর সীমানা জরিপের কাজ করতে হবে। একই সময়ের মধ্যে নদীগুলোকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং তার পরের ছয় মাসের মধ্যে নদীগুলো রক্ষায় দরকারি নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। নদীর সীমানা স্তম্ভ বসাতে হবে এবং নদী-সীমানায় পায়ে চলা পথ নির্মাণ ও বৃক্ষ লাগাতে হবে। একই সময়ের মধ্যে নদীর ভেতরে থাকা সব ধরনের স্থাপনা সরাতে হবে। ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠন করতে হবে।
ঢাকা মহানগরের চারপাশের চারটি নদী খনন ও পলিথিন থলেসহ অন্যান্য বর্জ্য ও পলি অপসারণ করতে হবে। আদালতে পরিবেশসংক্রান্ত বিচারাধীন মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নিতে হবে। পুরান ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধসহ নদীর তীরের সব সরকারি ভূমি থেকে দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনা সরাতে হবে। যমুনা-ধলেশ্বরী, ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা, পুরোনো ব্রহ্মপুত্র-বংশী, বংশী-তুরাগ, যমুনা-পুংলীখাল, তুরাগ ও টঙ্গী খাল খনন করতে হবে। এ রায়ের বাস্তবায়িত হয়েছে যৎসামান্যই। এখন পর্যন্ত ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠিত হয়নি। এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে, নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দেশের সব নদীর উন্নতি করার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে নদী রক্ষা কমিশন না হওয়ায় এটি এখনো থমকে আছে।
মানুষের অসচেতনতা ও অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে নগরের চারপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীতে বর্জ্য আসছে একাধিক উৎস থেকে। নদীতে বা তীরে আবর্জনা ফেলা, নর্দমা দিয়ে নদীতে বর্জ্য যাওয়ার কারণে নগরের নদীগুলো দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর মতে, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানিদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ঘুষ দুর্নীতির কারণেই শিল্পমালিকরা নদীতে বর্জ ফেলতে সাহস পায়। চোখের সামনে ইটিপি ছাড়া চলছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। হাজারীবাগের প্রায় ১৮৫টি চামড়াশিল্প কারখানা প্রতিদিন গড়ে ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গত করছে। এই বর্জ্য মূলত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষিত করছে। বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীতে অপসারিত হচ্ছে ।
শীতলক্ষ্যায় অসংখ্য শিল্প কারখানার বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে এসে সরাসরি পড়ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, নদ-নদী ও অন্যান্য দূষণ বন্ধে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি বসাতে হবে। এসব কার্যক্রমে কোনো গতি নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বুড়িগঙ্গা নদীতে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে পুরান ঢাকার আশপাশে বুড়িগঙ্গা তীরে পুলিশ প্রহরা বসানোর কথা বলেছেন আদালত। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা করা হচ্ছে না। ফলে আগের মতোই বুড়িগঙ্গা তীর ও এর ভেতরে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে পলিথিন ওঠানোর সরকারের কার্যক্রমও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। দূষণে দূষণে ভারী এই নদীর পানিতে তখন দুর্গন্ধের মাত্রাও থাকে বেশি। ভরা বর্ষায় নদীর গতি কিছুটা বাড়লেও এর দূষণ আর কমে না। তাই মৃতবৎ নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে তা আর সুপেয় করার সুযোগ পাচ্ছে না ঢাকা ওয়াসা। এইতো অবস্থা আমাদের নদীগুলোর। কেবল রাজধানী ঢাকার পাশের নদী রক্ষা নয়; এ মুহূর্তে সারা দেশের নদীগুলোকে রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সম্পাদক
নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম,
[email protected]
০১৭১৩-৩৩৪৬৪৮