জরায়ুমুখের ক্যান্সারঃ জেনে নিন প্রতিরোধের উপায়

প্রকাশিত: জানুয়ারী ৩১, ২০২৩, ০৪:০৭ দুপুর
আপডেট: জানুয়ারী ৩১, ২০২৩, ০৪:০৮ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

আমরা সবাই জানি, ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক। আর নারীদের জন্য জরায়ুর  মুখে ক্যান্সার একটি নির্মম ব্যাধি। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্যানুসারে প্রায় ৫ কোটি বাংলাদেশী নারী জরায়ুর মুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এবং প্রতিবছর ১৭ হাজার ৬৮৬ জন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন ১০ হাজার ৩৬২ জন নারী। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমূহে ক্যান্সারে নারী মৃত্যুর প্রধান কারণ হল জরায়ুমুখের ক্যান্সার, যা নির্মুলের প্রধান উপায় হল প্রতিরোধ। কেননা গবেষণায় দেখা যায়, নারীর শরীরে এইচপিভি (Hpv) ভাইরাস প্রবেশের পর জরায়ুমুখে ক্যান্সার হতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। 

জরায়ুর মুখে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি : জরায়ুর মুখে ক্যান্সারের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল অনেক দেরিতে এর লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায়। ফলে রোগী দেরিতে আসে ডাক্তারের কাছে এবং রোগ নির্ণয় হতে বিলম্ব হয়, এমনকি অনেক সময় তা চিকিৎসার আওতার বাইরে চলে যায়। আর তাই এর লক্ষণসমূহ জেনে রাখা খুবই জররী। পিরিয়ডের বাইরে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, সহবাসের পর রক্তক্ষরণ, অতিরিক্ত এবং দুর্গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব, মেনোপজ বা  ঋতুবন্ধের পরে পুনরায় রক্তক্ষরণ, তলপেটে বা কোমরে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে। 

কত বয়স জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ : যেহেতু যৌন সংযোগের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়, এ কারণে যৌনজীবন শুরুর পূর্বে এ রোগের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আক্রান্তরা সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী হয়ে থাকে। ৬০ বছর বয়সের পরেও এ রোগ নির্ণয় হতে পারে, তবে তা সংখ্যায় নগন্য। 

জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য কেন : জরায়ুর সর্বনিম্ন অংশ জরায়ুমুখ (Cervix)  নারী শরীরের এমন অংশ যা কিনা খালিচোখেই পরীক্ষা করা সম্ভব। এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর স্বাভাবিক কোষ থেকে ক্যান্সারে রূপ নিতে দীর্ঘ সময় লাগে বিধায় নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে সহজেই আমরা এই অঙ্গের অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করতে পারি। এছাড়া সময়মতো টিকা প্রদানও জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের অন্যতম একটি উপায়।

চলুন জেনে নিই, জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকিসমূহ কি কি?

বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অল্প বয়সে সন্তানের জন্ম, ঘন ঘন অনেক বেশী সন্তানের জন্ম, দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস, ঝুঁকিপূর্ণ যৌনজীবন, নারীর নিজের কিংবা তার জীবনসঙ্গীর একাধিক যৌনসঙ্গী, একটানা দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ, ধূমপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ ইত্যাদি জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

আসুন, জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং সম্পর্কে জানি। 

আমাদের দেশে ত্রিশ বছর বা তদুর্ধ্ব মহিলাদের এবং যেসব মহিলা দশ বছর বিবাহিত জীবন অতিক্রম করেছেন, তাদের বিনামূল্যে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ‘ভায়া’ নামক একটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন বাংলাদেশ সরকার। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে রয়েছে এই ভায়া পরীক্ষার সুবিধা। এছাড়া বেসরকারিভাবে নিজ খরচে প্যাপ টেস্ট বা এইচপিভি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা যায়। ষাট বছর বয়সের পরে আর জরায়ুমুখ স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন নেই।

জরায়ুমুখের টিকা কারা এবং কখন দিবেন?

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের প্রাথমিক ধাপ হল টিকা। নয় বছরের পর থেকে শুরু করে প্রতিটি মেয়েকে এইচপিভি টিকা দেয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি এবং এসিআইপি। বিশেষতঃ বিয়ে বা যৌনজীবন শুরুর পূর্বেই এই টিকা গ্রহণ করলে খুব সহজেই ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়। এইচপিভি টিকা জরায়ুমুখ ক্যান্সারের আশঙ্কা প্রায় ৮৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়।  এই টিকার ডোজ ০.৫ মিলি, যা ০,১ এবং ৬ মাসে মাংসপেশীতে দেয়া হয়। তবে গাইডলাইন অনুযায়ী, ৯-১৪ বছর বয়সী বা অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে দুটি ডোজই যথেষ্ট, যা ছয় মাসের ব্যবধানে দেয়া হয়। আমাদের দেশে প্রতি লাখে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের হার ১০.৬ এবং এতে মৃত্যুহার ৭.১, যা এই রোগের চরম ভয়াবহতা নির্দেশ করে। একদিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর লক্ষণ না বোঝা, অন্যদিকে এ রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি জটিল, অপ্রতুল এবং ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে নারী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে আছে। 

অবশেষে এটি বলা যায় যে, জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি সম্পর্কে জেনে সেগুলো এড়িয়ে চলা, সময়মতো টিকা গ্রহণ এবং ত্রিশ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত জরায়ুমুখ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই হতে পারে এমন নীরব এবং ভয়াবহ ঘাতকের হাত থেকে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠির এ নারীসমাজকে রক্ষার একমাত্র উপায়। 

আসুন, আমরা সচেতন হই। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের হাত থেকে নিজে এবং নিজের পরিবারকে রক্ষা করি। 

ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা
এমবিবিএস; বিসিএস(স্বাস্থ্য) 
এফসিপিএস(অবস্ এন্ড গাইনী)
ফিগো ফেলো(ইটালী)
গাইনী কনসালটেন্ট, 
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বগুড়া
ডক্টরস ক্লিনিক(ইউনিট-১), বগুড়া। 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়