কবি নজরুল ও পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী স্মরণে

এড. মোঃ মনতেজার রহমান মন্টু 

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২৩, ০২:৫৯ রাত
আপডেট: মে ২৫, ২০২৩, ১১:২৯ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছিলেন কাল বৈশাখীর ঝড়। বৃটিশদের বিতাড়িত করতেও কম ছাড়েননি। বিদ্রোহী এবং আনন্দময়ীর আগমন কবিতা দুটি লিখে বৃটিশদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন সেই জন্য তিনি জেল হাজত খেটেছেন। মাত্র ২৩ বছরের সৃজনশীল জীবনে যে ব্যাপক পরিচিতি তাঁর ছিল। তার চেয়ে নিন্দে অপমান তাঁর ভাগ্যে কিছু কম জোটেনি।

তবু প্রচুর তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যেও অদ্ভূত প্রাণবন্ত পুরুষ ছিলেন তিনি। সেই কবির ছোট পুত্র অনিরুদ্ধর স্ত্রী ছিলেন কল্যাণী কাজী। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে রাঁচীতে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ আলাপ হয়ে গেল সুদর্শন ছেলেটিকে দেখে, কি চেহারা। গীটারের সাথে আমি গান করলাম, অদ্ভূত বাজালো। সেই সময় ছিল বাংলা গানের স্বর্ণময় যুগ। ১৫/১৬ বছরের জীবনে সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু বুঝতে পারেনি আমার মত একজন সাধারণ মেয়েকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলবেন।

মনে হয়েছিল এটা নিছকই শিল্পীর খেয়াল। শেষে জয়ী হলাম। কল্যাণী কাজী বলেন আমার জীবনে কবি নজরুল দেখা দিয়েছিলেন “মৌন সুন্দর” রূপে। তাঁকে যখন প্রথম দেখলাম, তখন তাঁর মাথায় ছিল না ঝাঁকড়া চুলের রাশি বা বড় দীঘল কালো চোখে চঞ্চল দৃষ্টি। মৌন কিন্তু অদ্ভূত মুখর ছিলেন তিনি। প্রথম যখন তাঁর সামনে গেলাম, তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর ছোট ছেলে অনিরুদ্ধর দিকে তাকালেন। অনিরুদ্ধ হেসে বললেন, “বাবা, আমার বউ”।

তিনি হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। এ পরিবারে আমার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। কবি নজরুলের পারিবারিক জীবনের ইমারত কখনই শক্ত ভিতের উপর গড়ে ওঠেনি। কল্যাণীর শাশুড়ী অসুস্থ: শ্বশুর বাবা কবির মস্তক বিকৃত, কবির শাশুড়ী দিদি মা গিরিমালা দেবী যিনি বিধবা হয়েও অসুস্থ মেয়ে জামাইকে দেখাশোনা করার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে ছিলেন-তিনি যখন নিন্দার মধ্যে বসবাস করতে করতে আর সহ্য করতে না পেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। আর খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন অল্প বয়সে অভিভাবকহীন দুই ছেলে সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধর জীবন হলো কান্ডারীহীন নৌকার মতো।

এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ছোট পুত্র বধূ কল্যাণী কাজী সংসারের হাল ধরেন। ১৯৫৫ সালে ২৩ ডিসেম্বর কলিকাতায় মানিকতলার ১৬ নং রাজেন্দ্র লালা স্ট্রিটের বাড়িতে পাকাপাকিভাবে কল্যাণী কাজী বসবাস করতে আসেন। তিন তলায় দুটো আর চারতলার ঘর নিয়ে ছিল কবি পরিবারের বসত। নীচ থেকে পানি কলস ভর্তি করে নিয়ে নিয়ে ৩য় তলায় ৪র্থ তলায় গিয়ে রান্না বান্না করতে হতো।

কল্যাণী কাজী শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দেখেন শাশুড়ী পক্ষাঘাত রোগে শয্যাশায়ী। কোমর থেকে নীচ দিকে অবশঃ হয়ে গেছে। ওই অবস্থায় শাশুড়ী কবিকে ঔষধ পত্র সহ অন্যান্য খাদ্য খাবার খাওয়াতেন। আবার শ্বশুর কবি তার স্ত্রীকেও সমভাবে সেবা যত্ন করতেন। কল্যাণী কাজী পুত্রবধূ হয়ে গিয়ে সেবা যত্ন সহ সব দায় দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়ে যায়। কল্যাণী কাজী শ্বশুর গৃহে দেখেন অনিরুদ্ধর নিজস্ব থাকার ঘর নেই। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে শ্বশুর কবিকে অসুস্থ শাশুড়ীর বিছানায় নিয়ে গিয়ে রেখে কল্যাণী স্বামীকে নিয়ে শ্বশুড়ের বিছানায় তাদেরকে থাকতে হতো।

শাশুড়ী আবার গান খুব ভালবাসতেন। কল্যাণী কবি নজরুলের পুত্রবধূ হওয়ার অনেক আগে থেকে নজরুল সংগীত করতেন। সে যখন গান করতো বাকরুদ্ধ শ্বশুর কবি বড় বড় চোখ করে কল্যাণীর গান শুনতেন। যখন গান শুনতো তখন শ্বশুর চুপ চাপ থেকে গান শুনতো। তখন মনে হতো কবি নজরুল সম্পূর্ণ ভাল মানুষ সুস্থ। 
প্রতি বছর শ্বশুর কবি নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে ২৫মে তারিখে দলে দলে শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মিরা ফুল নিয়ে এসে নজরুলের গলায় পড়ে দিয়ে কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতেন।

তাদেরকে বসতে দিয়ে কবি সামনে রাখা হারমনিয়ামটা দেখিয়ে ইশারা দিয়ে কল্যাণীকে গান গাইতে বলতেন। কল্যাণীর শ্বশুরকে খুশি করার জন্য ছন্দবহুল গান করতেন। সেই গান শুনে কবির দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তো জলের ধারা। সঙ্গে সঙ্গে আবার কবি খুশি হয়ে তাঁর গলার ফুলের মালাগুলো পুত্রবধূ কল্যাণীর গলায় পড়িয়া দিয়ে হাসাহাসি করতেন। কল্যাণী যখন গান করতেন কবি তখন চুপচাপ কানপেতে শুনতেন তখন দেখে মনে হয় কবি দিব্যি ভাল ও সুস্থ মানুষ।

কল্যাণী কাজী এবং অনিরুদ্ধর সাংসারিক এবং কবির পরিবার জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করতে বহু সময় বহু লেখার সময় কম। তাঁদের জীবনে অনির্বান, অরিন্দম ২ পুত্র এবং অনিন্দিতা নামে ১টি কন্যা রেখে ৮৭ বছর বয়সে গত ১২ মে শুক্রবার না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কল্যাণী কাজী।

ভারত সরকার তাঁকে “সংগীত মহাসম্মান” এ ভুষিত করেছেন, স্বামী অনিরুদ্ধ অনেক আগে ১৯৭৪ সালে ইন্তেকাল করেছেন। অনিরুদ্ধ ১৯৩১ সালে জন্মেছিল। কল্যাণী কাজী কবি নজরুল সহ পরিবারের আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি।


লেখক:  সভাপতি, নজরুল পরিষদ, বগুড়া
আইনজীবী ও কলামিষ্ট 
০১৭১১-৪২৫৯৮১

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়