মিজানুর রহমান রাঙ্গা
সাহিত্য জগতে একজন গুণী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজ বাড়ি কিংবা এলাকার মানুষ কম জানলেও দেশের সাহিত্যের অঙ্গনে ছিলো ওনার সরব উপস্থিতি। সাহিত্যের দখল ছিলো অনেক উচুতে। সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম আজও তাকে একটি অনন্য মানের জায়গায় রেখেছে। যা চিরকাল স্বরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের চারপাশের সাহিত্যমনাদের কাছেও ছিলেন তিনি একজন স্বপ্নপ্রজ লেখক।
তিনি কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ১৯৪৩ সালে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার গটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার ডাক নাম ছিলো মঞ্জু। পৈতৃক নিবাস ছিলো বগুড়ায়। তার বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তার মায়ের নাম মরিয়ম ইলিয়াস।
তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অর্নাস ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কৃতিত্বের সাথে। বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখন কলেজ) প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার প্রতিও ঝোঁক ছিলো। বেশ কয়েকটি কবিতাও লিখেছিলেন।
তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা কখনো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশিত হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৭ সালে। এছাড়াও আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার আরেকটি উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। আখতারুজ্জামান এর বই সমগ্র-তে মোট দুটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধ সংকলন রয়েছে। ‘খোয়াবনামা’কে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হলেও আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের ছোটগল্পগুলোও পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা। এমনকি সমালোচকদেরও প্রশংসা পেয়েছে। তার রচনা ছিলো বিশ্লেষণধর্মী।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই সমূহ-তে তাই কিছু স্বাদ পাওয়া যায় রাজনীতির। তার লেখার মাধ্যমে সমষ্টি ও ব্যক্তিকে দিয়েছেন সমান মর্যাদা। মুক্তমনা এ লেখক ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিশির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন একজন স্বল্পপ্রজ লেখক। ভালো লেখক হিসেবে সেসময় ছিলেন সমাদৃত। দুটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন নিয়েই তার রচনা সম্ভার। এ অল্প সৃষ্টি কর্মই তাকে করে তোলে সমাদৃত।
বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তার রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত লেখকের সম্মান পান। তার লেখা উপন্যাস হল চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা, ছোটগল্প হল দুধভাতে উৎপাত, কান্না, নিরুদ্দেশ যাত্রা, জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল প্রভৃতি।
সংস্কৃতির ভাঙা সেতু হল তার একমাত্র প্রবন্ধ সংকলন। তার সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, ‘কি পশ্চিম বাংলা, কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ লেখক’। এদেশের কথা সাহিত্যকরা বলেছেন, ‘গত ১৫ বছরের মধ্যে তার দু’টি উপন্যাসেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।’ যা আলোচিত হয়েছে। কুড়িয়েছে প্রশংসা।
তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবদ্দশায় তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার এবং একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। গুণী এই লেখকের স্মৃতি যে বগুড়া তথা উত্তর এলাকার সাথে জড়িয়ে আছে, তা অনেকেরই অজানা। তাই আজকের তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে এ লেখাটি হয়তো না জানা অনেককে জানিয়ে দেবে তার গুণের কথা। শ্রদ্ধেয় আকতারুজ্জামান ইলিয়াছের মত আরও ক্ষণজন্মা মানুষ আমাদের মাঝে তৈরি হোক। আর এভাবে সমৃদ্ধ হোক বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন।
লেখার মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন সকলের মাঝে। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
লেখক: গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী
01719-516652
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।