এমরান কবির
এককথায় যদি উত্তর দেয়া যায় তাহলে বলতে হবে আমাদের অর্থনীতি যতটা স্বস্তিতে আছে তার চেয়ে বেশি আছে সংকটে আর চ্যালেঞ্জে। আমরা যদি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারি আর সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারি তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু বিষয়টা কি অত সহজ?
ইতিবাচক কথা দিয়েই শুরু করি। আমাদের অর্থনীতির কতিপয় পরিস্থিতি স্বস্তিতে রেখেছে। যেমন কৃষি উৎপাদন, রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি (যদিও ফেব্রুয়ারিতে একটু কমেছে), রেমিটেন্সে অব্যাহত গতি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৃহৎ অবকাঠামোর সফল সমাপ্তি। এইসব ইতিবাচক পরিস্থিতির বিপরীতে সংকটগুলো কী কী সেদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
সংকটগুলোকে মোটাদাগে বলা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অনিশ্চিত যাত্রা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ঘাটতি, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে তারল্যে ভাটা, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, বিনিয়োগে স্থবিরতা, ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এছাড়াও রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপর নির্ভর করছে আমাদের অর্থনীতির বাস্তব পরিস্থিতি।
চ্যালেঞ্জগুলোকে মোটামুটি এভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে- গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট নিরসন, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি ও রেমিটেন্সে টেকসই প্রবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বলা বাহুল্য সংকটগুলো নিরসনে চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেই। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের ব্যাপার। এখানে জড়িয়ে গেছে বিভিন্ন পক্ষ ও পরাশক্তি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে ধীরগতি ইচ্ছাপ্রসূত। কারণ যতই ধীরগতিতে করা হবে ততই প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হবে। ততই ইনকাম। তাতে দেশের অর্থনীতি কোথায় গেল দেখবার দরকার নেই। জনগণের টাকার কী হাল হলো তা দেখে তাদের কী হবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন ও ঘাটতি নিরসনে বাস্তবিক কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে সংস্কারের জন্য ব্যাংকিং কমিশনের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক-খাত বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কর্ণপাত করার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ দেশে আছে বলে মনে হয় না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাজার মনিটরিং এর কথা বলা হয়। কিন্তু কোনো ফল তো আজও চোখে পড়ল না। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট আজও নিরসন হলো না।
দেখতে দেখতে শুষ্ক মৌসুম চলে এলো। কৃষি খাত নিয়ে স্বস্তিতে থাকলেও প্রয়োজনানুসারে সেচ দিতে না পারলে এই খাতও সংকটের মুখে পড়বে। তখন প্রধানমন্ত্রীর এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখার আহ্বান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? গ্যাস ও বিদুুু্যুৎ খাতের সংকট নিরসনে এখনই বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে।
স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অধিকতর মনোযোগী হতে হবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতি ও নীতি সহায়তা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এগুলোর সাথে নতুন কর্মসংস্থানের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এইসব খাতে উজ্জীবনের সৃষ্টি হলে নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। রপ্তানি ও রেমিটেন্সে সরকারের কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপের জন্য ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এই নীতি সহায়তা ও পদক্ষেপ আরো বাস্তবমুখী করতে হবে। নির্বাচনের বছর হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ! খুব অপ্রিয় হলেও সত্য যে এই জিনিসটি দেখার জন্য বোধকরি কেউই নেই।
আমরা অর্থনীতিতে অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছি। সন্দেহ নেই। আমাদের তথ্য উপাত্ত ও নির্দেশকগুলো বেশ উর্ধ্বমুখী। কিন্তু সাধারণ অর্থনীতির নির্দেশকগুলো সবসময় জন অর্থনীতির বাস্তবতার সাথে মেলে না।
এর একটি বাস্তব উদাহরণ কয়েকদিনের পত্র পত্রিকা ঘটলেই টের পাওয়া যায়। কযেকদিন আগে দেশের প্রায় সবগুলি পত্রিকায় সংবাদ হিসেবে এসেছে যে নওগাঁর একটি এলাকায় একশত পঞ্চাশ গ্রাম মুরগীর মাংস বিক্রি হচ্ছে, আর চট্টগ্রামের একটি বাজারে ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে আড়াইশত গ্রাম গরুর মাংস বিক্রি করা হবে।
এখন আসা যাক আমাদের মাথাপিছু আয়ের হিসাবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী আমাদের মাথাপিছু যা আয় দেখানো হচ্ছে তা বছরে প্রায় তিন লাখ টাকার উপরে। ধরা যাক তিন লাখ। তিন লাখ টাকা বছরে ইনকাম করলে প্রতি মাসে গড়ে পঞ্চাশ হাজার। এখন আসেন কেউ যদি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম করে তাহলে সে-কি আড়াইশত গ্রাম মুরগীর মাংস কিনতে যাবে? এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। সেটা হলো আমাদের মাথাপিছু আয় সমতাভিত্তিক নয়।
সমাজ ও অর্থনীতিও সমতাভিত্তিক নয়। এজন্য অর্থনীতির সাধারণ সূত্র এখানে খাটছে না। এগুলো দেখারও কেউ নেই। সমতা ও সুষমবন্টনভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতি হলে এরকমটি হবার নয়। যে যেখানে যেভাবে পারছে মেরে দিচ্ছে। বিখ্যাত উর্দু লেখক সাদাত হোসেন মান্টো (যিনি একই সাথে নন্দিত এবং নিন্দিত। বাংলাদশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি বাংলাদশেকে সমর্থন দেয়ায় বাংলাদেশে নন্দিত, একই কারণে পাকিস্তানে নিন্দিত)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।
দেশ কেমন চলছে। তিনি বলেছিলেন, দেশ চলছে জেলখানায় জুম্মার নামাজ পড়ার মতো। সেটা কেমন? প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন, ধরেন জেলখানায় জুম্মার নামাজ পড়া হবে। একজন আজান দিলো। সে তো ডাকাতির আসামি। ইমাম খুতবা দিলো এবং নামাজ পড়ালো। সে চুরির আসামি। নামাজ পড়লো যারা সবাই বাটপার। আমাদের দেশটা কবে জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্তদেশ হবে?
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, ব্যাংকার
01719-455492
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।