পুরান ঢাকায় নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কথা মানুষ এখনও ভোলেনি। ২০১০ সালের ৩ জুন ঘটেছিল এই মারাত্মক দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় শতাধিক লোক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। আহত হন দুই শতাধিক। এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা সেখানে সৃষ্টি করে এক হৃদয় বিদারক ট্র্যাজেডির। দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
দাবি ওঠে কেমিক্যাল গুদামগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার। তবে এত বছর পার হলেও আজও কিন্তু কেমিক্যাল গুদাম সরানোর যে কথা উঠেছিল সে কাজটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা যেমন গৌরবময় কোনো ঘটনা বা স্মৃতি ভুলতে সময় নিই না, ট্র্যাজেডি বা দু:খজনক ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই। বিশেষ করে দুর্ঘটনাজনিত ঘটনাগুলো দ্রুতই ভুলে যায় সবাই।
এইতো সেদিনও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। এর পরপরই সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হলো, সিদ্দিকবাজারে গ্যাস লিকেজ থেকে বহুতল ভবনে বিস্ফোরণে প্রাণ গেল ২৩ জনের।
এর আগে গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে তিনটি অগ্নিকান্ডে পুড়েছে ছয়টি বস্তি। এ ছাড়াও ভেড়ামারা বস্তিতে এক অগ্নিকান্ডে পুড়েছিল ৯টি তাজা প্রাণ। আমরা মনে করি সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও মানুষ সচেতন ও সতর্ক হলে এই ধরনের বেদনাদায়ক অগ্নিকান্ড, বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। দেশে সংঘটিত অন্যান্য অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের অগ্নিকান্ড ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কার্যক্রমের বার্ষিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সারা দেশে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি, ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এক বছরের ব্যবধানে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৫০১টি। সারা দেশে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৬টির বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি) থেকে ৩ হাজার ৩৬৮টি, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৯ হাজার ২৭৫টি, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৩ হাজার ৮৭৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে।
রাজধানী ঢাকাতে একের পর এক বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানেই নানাভাবেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে -যা অত্যন্ত উদ্বেগের। অগ্নিকান্ডের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩৯ ভাগ ক্ষেত্রেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে। এ ছাড়াও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং চুলা থেকে সৃষ্ট আগুন থেকেও বহু মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে।
অগ্নিকান্ড থেকে রেহাই পায়নি বস্তি থেকে শুরু করে কেমিক্যাল গোডাউন কিংবা আধুনিক বহুতল ভবনও। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া বড় বড় অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও সতর্ক না হওয়ায় অগ্নি দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে আমরা মনে করি, এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বলাই বাহুল্য, রাজধানীতে জীবন-জীবিকার সুযোগ যেমন বেশি, তেমনি মানুষের বিচক্ষণ ও বিপন্নতার অন্ত নেই। প্রান্তিক মানুষের আবাসনের অসহায়ত্ব ও অনিরাপত্তা এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বস্তিবাসীর বিকল্প নিরাপদ আবাসনের ক্ষেত্রে বড় কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে উচ্ছেদে পথে বসা, অগ্নিকান্ডে জানমাল খোয়ানো যেন বস্তিবাসীর নিয়তি হয়েই দাঁড়িয়েছে।
কিছু দিন পর পর একেকটা ট্র্যাজেডি নাগরিক সমাজে বেদনা, উদ্বেগ ও হতাশা সৃষ্টি করছে। এসব দুর্ঘটনায় যে বিপুল প্রাণহানি ঘটছে তা যেমন যেমন সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য শোকাবহ পরিণতি ডেকে আনে, তেমনি আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার সার্বিক দুর্বলতা ও অনিয়ম প্রকাশ করে। আমাদের উন্নয়ন যাত্রাকে নাগরিকদের জন্য নিরাপদ করতে না পারলে তা বারবার এ ধরনের ট্র্যাজিক পরিণতি বয়ে আনবে।
আমরা আশা করব বিভিন্ন অগ্নিকান্ড থেকে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করবে। উন্নয়ন ও নিরাপত্তা যেন একে অপরের পরিপূরক হয়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।