ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে কেউ একজন ক্ষীণস্বরে ডাকছেন, ‘কেউ আছেন? এখানে একজনের মৃতদেহ পড়ে আছে, কেউ একটু সাহায্য করুন’। এই আর্তনাদ যিনি শুনছেন, তিনি একা....উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন-যদি কোনো উদ্ধারকারী দল আসে। কিন্তু আশে পাশে কেউ নেই। এমনই হাজার হাজার মানুষের অসহায় আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত অঞ্চল।
আর উদ্ধারকর্মিরা ছুটছেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে; তবে হতাহত যেন তার চেয়েও দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে। মঙ্গলবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুই দেশে নিহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা ১৭০০ জনের বেশি রয়েছে। তুরস্কে আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।
এমন শোচনীয় পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ১০ প্রদেশে ৩ মাসের জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আশংকা করছে, ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে দাঁড়াতে পারে, যার মধ্যে বড় একটি সংখ্যা শিশু ও বৃদ্ধ রয়েছেন। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আশা করব, উদ্ধার কাজে ও পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে এসে দাঁড়াবে সারা বিশ্ব।
ভূমিকম্পের পর একশটির বেশি আফটার শক নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) আরও ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্পের আশংকা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া হিমশীতল ও গুমোট আবহাওয়ার মধ্যেই দুই দেশের উদ্ধারকর্মিরা ধ্বংসাবশেষে আটকে পড়া জীবিত উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোরে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর প্রায় ৪০-৫০ ঘন্টার বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরবর্তী ২৪ ঘন্টা সবচেয়ে সংকটাপন্ন। কেননা যারা ধ্বংস স্তুপের নিচে বেঁচে আছেন, তাদের এই সময়ের মধ্যেই উদ্ধার করতে হবে। তা না হলে অক্সিজেন ও পানীয় জলের অভাবে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। ভূমিকম্পে হাজার হাজার বহুতল ভবন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। অন্তত ৫ হাজার ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। রিখটার স্কেলে এ ভূ-কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮।
সিরিয়ার আলেপ্পো ও হামা শহর থেকে তুরস্কের দিয়ার বাকির পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩০০ কিলোমিটারের বেশি বিস্তৃত আন্ত: সীমান্ত এলাকায় আঘাত হানে এ ভূমিকম্প। প্রথম কম্পনের ১১-১৫ মিনিটের ব্যবধানে নিকটবর্তী স্থানে দ্বিতীয়বার এবং এরপর আরও একবার আঘাত হানে এ ভূমিকম্প।
বিশেষজ্ঞরা জানান, তুরস্কের পার্বত্য অঞ্চলের নিচে রয়েছে তিনটি টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান। এগুলোর চ্যুতি, সঞ্চরণ বা সংঘর্ষের কারণে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা সব সময় থাকে। তুরস্কে গত এক দশকে একাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এসব অঞ্চলে ভূমিকম্প সহনশীল বাড়িই বানাতে হবে। অন্যথায় ব্যাপক প্রাণহানিসহ সম্পদহানি ঠেকানো যাবে না। বর্তমানে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। এরই রেশ ধরে ভূমিকম্পের হারও বাড়ছে।
ভূমিকম্পের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচন্ড শীতের মধ্যে তুষারে ঢাকা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়, তুরস্কের ১০টি শহরে এই ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষদের প্রতি সহানুভূতির ভাষা আমাদের নেই। আমরা একাধিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দুটি দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীকে আহবান জানাই। একই সঙ্গে মেগাসিটি ঢাকার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের আশংকা যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে রাজধানী ঢাকায়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা হতে পারে সাড়ে আট থেকে নয়। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে এমন আশংকা করছেন গবেষকরা। এই নগরীতে ভবন কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেয়া হয় না ভূমিকম্পের বিষয়টি, এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে সচেতনতার অভাব। ঢাকায় আছে ৪ লাখের বেশি বহুতল ভবন। রাজউকের হিসেবে সে সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি।
এসব ভবনের অধিকাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয় বলে বার বার বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। আমরা মনে করি, জননিরাপত্তার কথা ভেবে সরকার সব নগরীর ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।