বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে অপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প, শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে ক্রমশ কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। একটি প্রতিবেদনের তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের পরে প্রতি বছর দেশের ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯.৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। গত চল্লিশ বছরে এই জমির পরিমাণ কমেছে ১.২৪২ মিলিয়ন হেক্টর।
আর জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। আর অতি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, দেশে এখন কৃষি খানার সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার, যাদের অধীন আবাদি জমি রয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর। তবে ১১ বছরের ব্যবধানে দেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে চার লাখ ১৬ হাজার একর। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর কৃষি জমি কমছে ৩৭ হাজার ৮১৮ একর। অন্যদিকে কৃষি খানার পরিচালনাধীন মোট জমি (আবাদি ও অনাবাদি) জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই সময়ে জমির পরিমাণ কমেছে ৫ লাখ ৩০ হাজার একর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষি শুমারি -২০১৯-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চলতি মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এর আগে কৃষি শুমারি হয়েছে ২০০৮ সালে। দেশের কৃষি পরিবারে পরিচালনাধীন মোট জমি বা কৃষি পরিবারগুলোর মালিকানায় যে জমি রয়েছে তার পরিমাণ হলো ২ কোটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার একর, যা ২০০৮ সালের শুমারিতে ছিল ২ কোটি ৩৫ লাখ ৫ হাজার একর। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কৃষি পরিবারগুলোর পরিচালনাধীন জমির পরিমাণ কমে গেছে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার একর।
অনেকেই বলে থাকেন- কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি দায়ী। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য আবাদি জমি অকৃষিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে কৃষি জমি কমতে থাকলে ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির মুখে পড়বে। দ্রুত নগরায়নের কারণে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ইটের ভাটা। সাধারণত বাংলাদেশের ছোট-বড় শহরগুলোতে কৃষিজমিতে দেখা যায় এইসব ইটের ভাটা। রাজধানীর আশে পাশে পরিকল্পনাহীনভাবে ইটভাটা গড়ে ওঠার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর।
একটি ইটভাটা তৈরি করতে অনুমান ২০ বিঘা জমি প্রয়োজন। শত শত অবৈধ ইটভাটা তৈরি হওয়ায় কত হাজার বিঘা কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এর সঠিক হিসাব কারও কাছে না থাকলেও পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা সহজে অনুমান করা যায়। আরও বিবেচ্য বিষয় হলো, জলবায়ুর প্রভাবে নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্প-কারখানা, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও যত্রতত্র বসতি প্রতিষ্ঠার কারণে সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন ২ শতাংশ কৃষি জমি অনাবাদি হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, এভাবে যদি আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যেতে থাকে এবং কৃষি জমি অনাবাদি হয়, তবে বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে-যা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। বিভিন্ন কোম্পানি প্রায় সারা দেশেই শত শত বিঘা জমি কিনছে। এতে কৃষকরা ভূমিচ্যুত হচ্ছে। কোম্পানিগুলো প্রথম দিকে কৃষি কাজের নাম করে কেনা জমিতে গাছপালা রোপণ বা বপন করে। পরে জমিটিতে মাটি ভরাট করে অন্য কাজে লাগায়।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি ভূ-খন্ড, অথচ জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনই মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অতি সামান্য। তারপরও যদি কৃষি জমি এমন দ্রুত হারে কমতে থাকে, তাহলে এই জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া একসময় কষ্টকর নয়, রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভূ-গর্ভের পানির স্তর অত্যাধিক নিচে নেমে যাওয়ায় এখনই অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি ওঠেনা। খাল-বিল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে যেতেও পারছে না।
এ অবস্থায় ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সর্বসাধারণের সচেতনতা কৃষি জমি হারানোর সমস্যা সমাধানে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। দরকার সরকারের সঠিক পরিকল্পনা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।