নদী দূষণ ও দখল পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তা সত্ত্বেও এ দেশে এটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা এ ব্যাপারে যতই সোচ্চার হোক না কেন কাজ হচ্ছে না। যারা পরিবেশ দূষণ করছে তারা কেবল প্রকৃতির শত্রুই নয় মানুষেরও শত্রু।
কারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে তারা। অথচ সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। নদী দূষণ ও দখল, বৃক্ষ কর্তন, পাহাড় কাটা, ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করা এসব কোনো ব্যাপারেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা চোখে পড়ে না। ফলে দেশের নদ-নদী দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে অবলীলায়।
আমরা জানি ইতিপূর্বে ঢাকার অদূরে তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। কারও বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের জন্য এবং ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণারও নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এ ব্যপারে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতের এ রায়কে ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে এর আগে ঘোষণা দিয়েছে চারটি দেশ। এগুলো হলো ইকুয়েডর, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও কলম্বিয়া। এই ঘোষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পঞ্চম। বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও অস্তিত্বের অনুষঙ্গ হলেও নদী রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতা প্রায় ক্ষমাহীন। নদীর ক্ষতি জীবন্ত মানুষের যেকোনো ক্ষতির মতোই অপরাধ বলে গণ্য হবে।
নগর জীবনে বেদখলকৃত নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাধার উদ্ধার ও সংরক্ষণের গুরুত্ব এখন প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন। উপর্যুপরি জলাবদ্ধতার কারণে বিষয়টি বর্তমানে এক রকম গণদাবিতেও পরিণত হয়েছে বলা যায়। প্রকৃতিকে থমকে দিয়ে মানবসভ্যতা গতি পাবে, এ ধারণা যে কত ভুল মানুষ এখন উপলদ্ধি করতে পারছে। সে জন্য সারা পৃথিবীতে চলছে নদী বাঁচাও আন্দোলন। ভারতের নর্মদা আন্দোলন থেকে নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন সবখানে চলছে নদী রক্ষা করার লড়াই। এক সময় পাশ্চাত্যেও নদী নিধন করে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার একটা ভ্রান্ত প্রয়াস চলছিল।
গত শতাব্দীর সত্তর দশকে নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আদালত থেকে বলা হয়েছিল, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন। এখন পশ্চিমে- সেটি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে অথবা জার্মানি বা ইতালি হোক-নদী সর্বোচ্চ আদরণীয়। রাষ্ট্র-জনগণ সবাই তা মানে। কিন্তু আমাদের দেশে নদী যেন সকলের পৈতৃক সম্পত্তি। যার ক্ষমতা আছে সে-ই নদীর ওপর অত্যাচার চালানোর অধিকার ফলায়। নদী দখল হচ্ছে, নদী দূষণ হচ্ছে।
দেখার যেন কেউ নেই, প্রতিবাদ আসছে কিছু সংগঠন থেকে। কিন্তু যারা প্রতিকার করবে তারা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। যে বুড়িগঙ্গা এক সময় ঢাকার গর্ব ছিল আজ তা শিল্প বর্জ্যে এত কলুষিত হয়েছে যে তার পানিকে কালির সঙ্গে তুলনা করা যায়। অনেকাংশে নদীর পানি আর বহমান নয়। বর্জ্যরে ভারে পানি স্থবির হয়ে গেছে। পানিতে অক্সিজেন নেই। নদীর প্রাণীগুলো মরে যাচ্ছে। এ কাহিনী পুরনো। তবুও আন্দোলনকারী এবং মিডিয়া এ বিষয়টি নিয়ে বলে যাচ্ছে যদি কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙে।
আইনি লড়াই ও সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল সহ হস্তান্তরের মহোৎসবে যেতে অভিযোগ উঠেছে তা কারোরই কাম্য হতে পারে না। একদিকে নদীপথকে সংকীর্ণ করে তোলা, অন্যদিকে এসব অপকান্ড করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তারা দেশের ভালো চায় এমনটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া নদী ভরাটের মাধ্যমে জমি দখলের মহোৎসবে অনেক প্রভাবশালীরাই জড়িত। মনে রাখতে হবে নদ-নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। দূষণ এবং অবৈধ দখলের হাত থেকে নদীকে বাঁচাতেই হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।