মোহাম্মদ নজাবত আলী
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে কৃষি, কৃষক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। কৃষি মূলত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবি কাঠি। ১৭কোটি মানুষের দেশে অধিকাংশই গ্রামে বাস করে। আবার গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই দেশকে বাঁচাতে হলে গ্রামকে বাঁচাতে হবে। কেন গ্রামকে বাঁচাতে হবে গ্রামের এত গুরুত্ব কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরও সহজ। কারণ দেশের মোট জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ গ্রামে বাস করে। আর অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোন ভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুর্ভাগ্য অধিকাংশ সময় কৃষক কৃষি পণ্যের ও ন্যায্য মূল্য পান না। কৃষকের বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও সাংসারিক ব্যয় মিটানোর জন্য বাধ্য হয় ধান বিক্রয় করতে। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ধানের ন্যায্য মূল্যের সঙ্গে দেশের আর্থ- সামাজিক ও কৃষকের স্বার্থ জড়িত বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। কেননা কৃষিই হচ্ছে অর্থনীতির মূল ভিত্তি।
আর এর মূল কারিগর হচ্ছে কৃষক। ইতিমধ্যে চালের মূল্য বেড়েছে। চালের মূল্য যেন না বাড়ে এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বার বার চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে দফায় দফায় বৈঠকও করেন। সরকারি গুদামে চাল মজুদ রয়েছে। চালের মজুদ থাকা সত্ত্বেও কেন দাম বাড়বে এর যৌক্তিকতার কোনো কারণ নেই।
এবারে আমন মৌসুমে সরকার দেশিয় বাজার থেকে এখনো ধান কেনা শুরু করেনি। এবার প্রতিকেজি ধান ২৮টাকা ও চাল ৪০টাকা দামে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারে আমন মৌসুমে ৫ লাখ টন ধান চাল ও ৩লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের লোকসান গুনতে হবে। কারণ এবারে বৈরী আবহাওয়ার কারণে কম বৃষ্টি হওয়ায় সেচের মাধ্যমে ধান উৎপাদন করতে হয়েছে। সারের মূল্য বৃদ্ধি, মজুরি, সেচ খরচসহ এবারে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। গত বছর উৎপাদন খরচ ছিল প্রতিকেজি ধান ২৫টাকা তা এবারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশ। উপরন্ত চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে।
অধিকাংশ খাদ্য পণ্যের দাম গত এক বছরে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি, ধানের উৎপাদন খরচ বাড়লেও ধানের দাম বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ গত বছরের চাইতে এবারে ধানের উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। গত মৌসুমে সরকার প্রতিকেজি ধান ২৭ টাকা দরে কিনেছে। এবারে তা মাত্র এক টাকা বাড়িয়ে ২৮ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ জলবায়ুর পরিবর্তন জ্বালানী গ্যাস সংকটে বৈশ্বিক মন্দার কারণে গোটা বিশ্ব তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। এবছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই খাদ্য সংকটের মধ্যে পতিত না হয় সে লক্ষ্যে সরকার না না ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্য মজুত বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বর্তমান দেশে ২০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ রয়েছে। উপরন্ত ৫-৬ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সরকার রাশিয়া ভিয়েতনাম সহ ৫টি দেশ থেকে চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চালের এত মজুত থাকা সত্ত্বেও চালের মূল্য বৃদ্ধি কেন এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭কোটি। এ বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের কৃষকরা ঝুঁকি নিয়েই কৃষি উৎপাদন করে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণা পশ্চিমাঞ্চলে কয়েকটি জেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় প্রতি বছরই ফসলহানি হয়। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে আবাদী জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানিতে তখন কৃষকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। ফলে কৃষকরা ঝুঁকিতে পড়ে। না পারে পরিবারের অভাব মেটাতে, না পারে মহাজন বা বিভিন্ন ধরনের এনজিও’র ঋণ পরিশোধ করতে।
উপরন্তু কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেলে তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। কৃষকরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত করে শিল্পায়ন করতে গিয়ে উৎপাদন যেন কমে না যায় সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। এটা ঠিক যে দেশের প্রয়োজনে শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিল্পের প্রসার ঘটলে কর্মসংস্থান বাড়বে, রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু শিল্পায়ন করতে হবে কৃষকের উৎপাদনকে ব্যাহত করে নয়। খাদ্য উৎপাদন কমিয়ে শিল্পায়ন করলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। উপরন্তু কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত, নিত্যপণ্য, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সহ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই।
যাহোক, কৃষি হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আর এর মূল কারিগর হচ্ছে কৃষক। সে কৃষককে যদি এবারে আমন মৌসুমে লোকসানের ফাঁদে পড়ে তাহলে কৃষক আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। যেভাবে ধান উৎপাদন খরচ বেড়েছে তাতে উপযুক্ত মূল্য না পেলে কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। এবারে আবহাওয়াজনিত কারণে সেচ মেশিনের উপর নির্ভর করতে হয়েছে কৃষকদের। বিদ্যুৎ চালিত সেচে প্রায় ৩৫ টাকা আর ডিজেল চালিত সেচে ৪০ টাকা সেচ বাবদ খরচ হয়েছে প্রতি শতকে। এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে শুধু সেচের খরচ পড়ে ১১৫৫ টাকা থেকে ১৩২০ টাকা অন্যদিকে ইউরিয়া সারের সংকটের কারনে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে সার না পাওয়ায় বেশি দামে কিনতে হয়েছে।
তবুও সময় মত সার মিলেনি। গত বছর এক লিটার ডিজেল ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে তা ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সার, জমি চাষ, সেচ, শ্রমিকে খরচসহ এক বিঘা জমির আমন ধান ঘরে তুলতে কমপক্ষে খরচ ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ধান উৎপাদন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ মণ। এমতাবস্থায় সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করলে কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। “কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে” এ শ্লোগানের গুরুত্ব অবশ্যই সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। তবে অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে এ সরকার কৃষি বান্ধব। কারণ এক সময় ছিল সারের দাবীতে কৃষকদের গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল। সে অবস্থা আর নেই। তবে মাঝে মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষি উপাদানসহ নিত্য পণ্যের মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে। যেমন এবারে সরকার সার ও ভোজ্যতেলের উপর অভিযান চালিয়ে বেশকিছু গুদাম থেকে তা উদ্ধার করে। তাই সরকারকে অবশ্যই এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর প্রকৃতির উপর মানুষের কোনো হাত নেই।
এবারে আমন মৌসুমে বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেচ দ্বারা ধান উৎপাদন করতে হয়েছে এবং খরচও বেড়েছে এ্টাই বাস্তবতা। “বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন” (বিএডিসি) এর এক তথ্য বলছে, এবার সারাদেশে প্রায় ৫লাখ সেচ মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিতে হয়েছে। যা বিগত সময়ের চেয়ে কয়েকগুন বেশি।
আমরা যদি অতিতের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে ১৯৭১সালে চালের উৎপাদন ছিল ১লক্ষ কোটি টন। কিন্তু ক্রমাগত ভাবে প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এর সাথে যুক্ত হচ্ছে খাদ্যের চাহিদা। কৃষকরা তো প্রায় প্রতি বছর উৎপাদন বাড়াচ্ছে। আর ধান উৎপাদনকারি দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বড় সমস্যা সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। উৎপাদন বেশি হলে দাম পড়ে যাবে, কম হলে বাড়বে। ধান চাল সংরক্ষণের জন্য সরকারের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার।
গত দু’দশক ধরে সরকারের গোডাউনগুলোর ধারন ক্ষমতা ১৮-২০লক্ষ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কৃষককে বাঁচাতে ধারণ ক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। যে কৃষক দেশের অর্থনীতির মূল কারিগর অথচ কৃষক ধানের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনা, করে সরকার। কিন্তু বিভিন্ন কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্য সামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাই দেখা যায় সাবানের গায়ে লেখা থাকে মূল্য ৩০টাকা। দেশি বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের স্নো পাউডারের খুচরা মূল্য লেখা থাকে ৪০টাকা। কিন্তু দুর্ভাগ্য কৃষকের। তারা শুধু উৎপাদক মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। সরকার শুধু মূল্য নির্ধারণ করেই খ্যাান্ত এর সুবিধা কৃষক পায়না।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]
০১৭১৯-৫৩৬২৩১
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।