ব্লু ইকোনমি ও ইন্দো প্যাসিফিক রাজনীতি
বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্ভাবনা ও ইন্দো-প্যাসিফিক ভূরাজনীতি এখন একে অপরের সঙ্গে অনিবার্যভাবে গাঁথা হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর আমাদের দখল, অনুশীলন ও কৌশলগত অবস্থান জ্যামিতিক হিসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এটি জাতীয় অর্থনীতি, নিরাপত্তা নীতি এবং পরিবেশগত টেকসইতার এক জটিল সমীকরণ। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত প্রায় ১১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল যা আমাদের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রসারিত এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ঊঊত) একটি প্রধান অংশ এই সংখ্যাটিই একদিকে আমাদের জন্য বিশাল সুযোগের ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে সেই সুযোগ বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন কাজ এবং নীতিগত পরিষ্কার রূপরেখা।
নীল অর্থনীতি (ইষঁব ঊপড়হড়সু) ব্যাপক: মৎস্য ও একুইকালচারে শুরু করে অফশোর ইনার্জি, বন্দরভিত্তিক অবকাঠামো, সামুদ্রিক পর্যটন, নৌপথ-নির্ভর লজিস্টিক জাল এসব মিলে একটি বড় খাত গঠন করে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় গবেষণা ও নীতিনির্ধারণমূলক নথি বলছে যে, বাংলাদেশের নীল খাত ইতোমধ্যেই দেশীয় জিডিপির কয়েক শতাংশ অবদান রেখে আসছে; বিভিন্ন বিশ্লেষণে মৎস্য ও একই কালচারের প্রত্যক্ষ অবদান ৩%-৩.৬% নাড়িয়ে আসে, আর যদি অফশোর গ্যাস, নবায়নযোগ্য সামুদ্রিক শক্তি এবং বন্দর-সেবা যোগ করা হয়, তবে এই অংশটি বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তবে সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই আছে শৃঙ্খলাবদ্ধ বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, উপকূলীয় পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আইনগত কাঠামো শক্ত করার চাহিদা যা ছাড়া সম্পদ আহরণ করলে তা দীর্ঘমেয়াদে ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
এই আর্থিক সম্ভাব্যতার পেছনে এখন কৌশলগত চাপও কাজ করছে। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ ধারণা ২০১০-এর পর থেকে দ্রুত ভূরাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠেছে; যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যাদেরকে কুইন্টেট বললে ভুল হবে না এই অঞ্চলের নৌন নিরাপত্তা, অবকাঠামো বিনিয়োগ ও সাপ্লাই-চেইন প্রতিরোধ কৌশলকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হচ্ছে (এদের মাঝে কিউএড বা ছঁধফ একটি সুপরিচিত ফোরাম)। কিউএড সদস্যদের কৌশলগত মনোভাব মূলত মুক্ত ও নিয়ম-ভিত্তিক সমুদ্র পরিবেশ বজায় রাখা কিন্তু বাস্তবে এটি চীনের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতার এক স্ট্র্যাটেজিক ঘরানায় এসেছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড বিনিয়োগগুলোর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় উপকূলে গভীর বন্দর ও লজিস্টিক হাব তৈরি করা হচ্ছে যেখানে গওয়াদার ও হাম্বানটোটার মতো বিনিয়োগগুলো কৌশলগত গুরুত্বের মতোই অর্থনৈতিক গুরুত্বও ধারণ করে। এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যেই বাংলাদেশকে তার কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিমাপ নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
ঢাকার নেওয়া ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ স্পষ্ট করে দেয় যে দেশের কৌশল মূলত “মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিয়ম-ভিত্তিক” সমুদ্রশাসনকে অগ্রাধিকার দেবে; কিন্তু এই নীতিগত ঘোষণাটি অনুধাবনযোগ্যভাবে কার্যকর করতে গেলে নির্দিষ্ট কর্মসূচি, বিচক্ষণ কৌশল ও বহুপাক্ষিক কূটনীতির সমন্বয় প্রয়োজন। ভূ-অর্থনীতিগত অনির্দিষ্টতার এক পাশে রয়েছে চীনা বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রলোভন; অন্য পাশে রয়েছে কিউএড ও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার একটি সূক্ষ্ম ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে- এই ভারসাম্যই ভবিষ্যতে আমাদের নীতিনির্ধারণকে নির্ধারণ করবে।
সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং সামরিক সক্ষমতা উন্নয়ন এই সাজশোভিত কৌশলের অপরিহার্য অংশ। ফোর্সেস গোয়াল ২০৩০’-এর মত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নৌবাহিনীকে অধিক ক্ষমতাশালী, নজরদারি সক্ষম ও বহুমাত্রিক অপারেশন চালাতে সক্ষম করার লক্ষ্য নিয়েছে; সাবমেরিন ও আধুনিক পৃষ্ঠতল যুদ্ধজাহাজ, প্যাট্রোল ক্যাপাসিটি এবং ইন্টেলিজেন্স-শেয়ারিং উদ্যোগগুলি নীতিগত ও কার্যকরী দিক থেকে নীতিনির্ধারণকে বদলে দিচ্ছে। যদিও সামরিক আধুনিকিকরণ দরকার, তবুও এটি শুধুমাত্র অস্ত্র বৃদ্ধির প্রশ্ন নয় এটি প্রতিরক্ষা-রাজনীতি, বন্দর নিরাপত্তা, সমুদ্রদস্যুতা প্রতিরোধ, মাদক ও মানব পাচার তদারকি এবং আবহাওয়াগত দুর্যোগে দ্রুত সাড়া দেয়ার দক্ষতার সঙ্গে জড়িত। এই দক্ষতার অভাব থাকলে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সহজে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন এই পুরো চিত্রকে আরও জটিল করে তোলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং তীব্র আবহাওয়া ঘূর্ণায়মান ঝুঁকি এসব কারণে উপকূলীয় জনবসতি, খাদক-জীবিকা ও বন্দর অবকাঠামো ঝুঁকিতে থাকে। ফলে নীল অর্থনীতি সম্পদ আহরণের লোকজ হিসেবে নয়; এটা ইতিমধ্যেই ম্যানগ্রোভ রিকভারি, সমুদ্র জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং উপকূলীয় সম্প্রদায়ের অভিযোজন নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ব্যাপক পরিবেশগত পরিকল্পনা। অর্থাৎ যদি আমরা অফশোর শক্তি বা বালুচরভিত্তিক লজিস্টিক ইনভেস্টমেন্টে ঝাঁপাই, তাহলে সেই উদ্যোগগুলোর সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়া তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক রিটার্ন দিতে পারবে না। বিভিন্ন গবেষণা প্রস্তাব করে যে, নীল অর্থনীতির সুফল পেতে হলে বন্দর উন্নয়ন, মৎস্য ব্যবস্থাপনা, একুইকালচার প্রযুক্তি এবং অফশোর শক্তিতে সমন্বিত নীতি ও বৈদেশিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা আবশ্যক।
আরও পড়ুনবাংলাদেশকে ভবিষ্যতে কেবল “সামুদ্রিক সম্পদ আহরণকারী” রাষ্ট্র হিসেবেই না, সাথে “নিরাপদ ও টেকসই সমুদ্রশাসন” গঠনের অংশীদার হিসেবে নিজেদের স্থাপন করতে হবে। এটির জন্য প্রয়োজন হবে স্পষ্ট নীতিগত কাগজপত্র, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বহুপক্ষীয় কূটনীতি যার মধ্যে থাকুক পরিবেশগত মানদন্ড, স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ এবং বহির্বিশ্বের সাথে সম্মিলিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। আমাদের কৌশল হওয়া উচিত: অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা কাজে লাগানো, আঞ্চলিক সহযোগিতায় অংশ নেওয়া এবং একই সঙ্গে বহুপ্রান্তীয় কূটনীতিতে এমন চুক্তি করা যা আমাদের সার্বভৌম স্বার্থকে রক্ষা করে। যদি আমরা এই উপায়ে এগোতে পারি, তবে আমাদের ১১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র শুধু সংখ্যা থেকে বিরাট সম্ভাবনার মাঠে পরিণত হবে একটি সুশৃঙ্খল, টেকসই ও কৌশলগতভাবে নিরাপদ নীল ভবিষ্যতের বীজ হিসেবে।
লেখক
নুসরাত রুষা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








