প্রতিটি শ্বাস হোক নির্মল বাতাসে পরিপূর্ণ
শুধু পানি নয়, বিশুদ্ধ বায়ুও জীবনের অপর নাম। জীবন বাঁচানোর জন্য পানির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বাতাস। বাঁচার জন্য আমাদের প্রতিদিন দুই থেকে চার লিটার পানি পান করলেই চলে, অন্যদিকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন শ্বাস নেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় ৫৫০ লিটার নির্মল বায়ু। বায়ু ছাড়া মানুষ, এমনকি কোন প্রাণিও কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। অথচ প্রকৃতিতে বিনামূল্যে পাওয়া এই মূল্যবান উপাদান কতভাবেই না দূষিত হয়ে শ্বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এক গবেষণায় জানা যায়-বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিরো কার্বন অ্যানালাইটিকস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৯ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। বায়ুতে সাধারণত ২১ শতাংশ অক্সিজেন, ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন, দশমিক ৩১ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নির্দিষ্ট অনুপাতে হাইড্রোজেন থাকে। কোন কারণে যদি বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় কিংবা বালুকণার হার বেড়ে যায়, তবে সেটি হয়ে যায় দূষিত বায়ু। আজকের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো-বায়ুদূষণ নগরজীবনের একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালেও এর প্রতিকারের জন্য দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। ধুলায় আচ্ছন্ন নগরটি যেন কুয়াশার মতো ঢেকে থাকে সারাক্ষণ। বাতাসে ভাসছে বিষ। এ বিষের উৎস হলো গাড়ি, আশপাশের শিল্পাঞ্চল, ইটভাটা, গৃহস্থালী ও ই-বর্জ্যসহ নানান ধরনের বর্জ্য। সিএনজিচালিত যানবাহন থেকে বের হয় ক্ষতিকারক বেনজিন। সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রল, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, অ্যালডিহাইডসহ সিসার নিঃসরণ বাতাসকে দূষিত করছে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বালু, সিমেন্ট ফেলে রাখা হচ্ছে রাস্তার পাশে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো বাতাসের সাথে মিশে সৃষ্টি করছে প্রকট ধুলাদূষণ। দূষিত বাতাসে ভেসে থাকে কঠিন ও তরল কণা, যার মধ্যে ধোঁয়া, ধুলা, ছাই ও বস্তু কণা উল্লেখযোগ্য।
বাতাসে মিশে যাচ্ছে আবর্জনার দুর্গন্ধ, গাড়ির কালোধোঁয়া আর নানান রকম অতি ক্ষুদ্র পদার্থ। তুলনামূলক বড় কণাগুলো নাক ও গলায় আটকে গিয়ে মানুষের শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে রক্ষা করে। কিন্তু অতি ক্ষুদ্র কণাগুলো কোথাও বাধা না পেয়ে ফুসফুসের একদম গভীরে পৌঁছে যায়, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বাইরের বায়ুদূষণ তো রয়েছেই, ঘরের ভেতরেও বায়ু দূষণ হয়ে থাকে রান্নার ধোঁয়া, তেল ও জ্বালানি পোড়ানো, ধূমপান ও রান্নার বর্জ্য যথাস্থানে না রাখার কারণে। যেসব ঘরে পর্যাপ্ত পরিমান বাতাস চলাচল করতে পারে না, সেসব ঘরে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র কণার পরিমাণ থাকে ভয়াবহরকম বেশি। মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাসহ বড় বড় শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা, ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি রোগ ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা যায়-শুধু বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ হাজার রোগীর অকাল মৃত্যু ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি ঘন মিটার বাতাসে দূষিত কণা ১০ মাইক্রোগ্রামকে সহনীয় সীমা হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই দূষিত কণা ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি পাওয়া যায়,যা রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে।
নির্মল বায়ু ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব বা আয়ু বৃদ্ধি অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন নির্মল বায়ু নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় নীতি গ্রহণ। বিশুদ্ধ বায়ু পরিবেশের আত্মা, সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার অপরিহার্য অংশ। তাই বাতাসকে নির্মল রাখার সকল প্রচেষ্টা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালাতে হবে। এজন্য জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ খুবই জরুরি। শুধু আইন করে এই দূষণ রোধ করা সম্ভব নয়। গাছ আমাদের নির্মল অক্সিজেন যোগান দেয়। সেজন্য আমাদের প্রতিটি বাড়ির ছাদে, শহরের প্রতিটি ফাঁকা জায়গায় প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। নির্মাণ কাজ চলার সময়ে বালু, সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। স্টিল, রি-রোলিং কারখানা, ইটের ভাটা, সিমেন্ট কারখানার বস্তুকণা যেন পরিবেশে সরাসরি আসতে না পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধের যে আইন রয়েছে, তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ফুসফুস ও রক্ত সঞ্চালনকে ক্ষুদ্রকণার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দূষণ দূরীকরণের জন্য এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। এয়ার পিউরিফায়ার ঘরের ভেতরের সকল দূষিত কণা ছেঁকে নিয়ে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। ঘরের রান্নাকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। বাইরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের পরিবহন, জ্বালানি, কৃষি, নগর পরিকল্পনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নির্মল স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে আমাদেরকেই। আমাদের প্রতিটি শ্বাস হয়ে উঠুক নির্মল বাতাসে পরিপূর্ণ। সবার কাম্য হোক এটাই।
লেখক
রাহমান ওয়াহিদ
কবি, কথশিল্পী ও কলামিষ্ট
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/151044