শীতকালে অতিথি পাখি  

শীতকালে অতিথি পাখি  

বাংলাদেশের শীতকাল শুধুই শীতের উষ্ণতা খোঁজার সময় নয়; এটি প্রকৃতির এক অনন্য উৎসবের ঋতু। যখন উত্তরের তুষারাচ্ছন্ন দেশগুলোতে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা নামে, ঠিক সেই সময় আমাদের দেশের আকাশে দেখা দেয় এক ভিন্ন রঙের শোভাযাত্রা অতিথি পাখিদের আগমন। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এখানে এসে তৈরি করে এক জীবন্ত রূপকথা, যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক নতুন অধ্যায়। দূর উত্তরের কঠিন পরিবেশ থেকে বাঁচতে পাখিরা যখন যাত্রা শুরু করে, তারা জানে বাংলাদেশ তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়। নদী-বিল-হাওরের সমৃদ্ধ জলাভূমি, খাদ্যের প্রাচুর্য, তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়া সবকিছুই তাদের টানে। সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, চীনের শীতল অঞ্চলের আকাশ ছেড়ে তারা যখন আমাদের দেশের দিকে এগিয়ে আসে, তখন তাদের যাত্রা হয়ে ওঠে জীবনের সংগ্রাম ও বাঁচার আশার এক শক্তিশালী প্রতীক। 

হাওরাঞ্চলের হিজল-করচ ঘেরা জলাভূমিগুলোতে অতিথি পাখিরা যখন নেমে আসে, তখন সেই দৃশ্য যেন এক অব্যক্ত সৌন্দর্যের জগতে নিয়ে যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর, পটুয়াখালীর জলাভূমি, চট্টগ্রামের উপকূল, মেঘনার চর সব জায়গা হয়ে ওঠে তাদের মৌসুমি ঠিকানা। চখাচখি, গার্গনি, পাতিহাঁস, বগা, গাংচিল, পানকৌড়ি তাদের দেখা মিললে মনে হয় শীত সত্যিই এসে গেছে। অতিথি পাখির পরিযান কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। প্রকৃতি তাদের শরীরে স্থাপন করেছে এক আশ্চর্য জৈব-ঘড়ি যা ঋতুর পরিবর্তন, সূর্যের আলো কমে আসা, বাতাসের তাপমাত্রা সবই বুঝতে পারে। তারা আকাশের নক্ষত্র মেপে, পৃথিবীর চৌম্বক রেখা অনুসরণ করে পথ ঠিক রাখে। যে নকশায় তারা বছরের পর বছর ঠিকঠাক একই জায়গায় পৌঁছায় তা মানব প্রযুক্তির যেকোনো জিপিএস-এর চেয়েও রহস্যময়। 

দীর্ঘ যাত্রার মাঝে পাখিরা বিভিন্ন জলাভূমিতে বিশ্রাম নেয়, যেগুলোকে বলা হয় ‘স্টপওভার সাইট’। এসব জায়গায় সামান্য খাদ্য ও বিশ্রাম তাদের পরবর্তী হাজার কিলোমিটারের যাত্রা টিকিয়ে রাখে। তাই এসব জলাভূমি শুধু আমাদের দেশের সম্পদ নয় এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইকোলজিক্যাল জোন। শীতের সকালে কুয়াশার ভেতর অতিথি পাখির ডাক শুনলে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিভৃতে গান গাইছে। নদীর ধারে, বিলের ওপর, ভোরের আলোয় তাদের ডানার শব্দ ভেসে আসে। গ্রামে কৃষকেরা বলে পাখি এলে বুঝি প্রকৃতি ভুল পথে নেই। শিশুরা দল বেঁধে নৌকায় উঠে তাদের দেখতে যায়; ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে চোখজুড়ানো মুহূর্তগুলো। বাংলাদেশে শীতকালে যে বৈচিত্র্যময় প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখা যায় তা পৃথিবীর অনেক দেশেই বিরল। কেউ আসে হাজার মাইল দূর থেকে, কেউ আবার আরও দূর এমনকি ৩,০০০-৭,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। এই বিশাল যাত্রা যেন তাদের জীবনের সাহস ও স্থিতিস্থাপকতার এক অনন্য উদাহরণ। অতিথি পাখিদের উপস্থিতি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায় না বরং পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জলাশয়ের পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে জলজ উদ্ভিদ ও মাছের বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি সবকিছুতেই তাদের অবদান রয়েছে। তারা জলাভূমির পরিবেশগত চক্রকে টিকিয়ে রাখে। বলতে গেলে, তারা প্রকৃতির ‘ইকো-ইঞ্জিনিয়ার’। পাখি কমে গেলে পোকামাকড় বেড়ে যায়, যা কৃষির ক্ষতি করে। আবার পাখিরা বীজ ছড়ানোর মাধ্যমেও বনজ গাছপালা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই অতিথি পাখিরা আসলে একটি দেশের পরিবেশ স্বাস্থ্যমানের নির্দেশক। অতিথি পাখি আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিষ্ঠুর শিকারিদের সক্রিয় হয়ে ওঠা আমাদের সমাজে এক অসুন্দর বাস্তবতা। কেউ কেউ খাদ্যের নামে, কেউ বিনোদনের নামে তাদের হত্যা করে। অথচ এ এক ধরনের পরিবেশগত অপরাধ।

যে পাখি হাজার হাজার মাইল উড়ে আসে, সেই পাখিকে হত্যা করা শুধু নিষ্ঠুরই নয় পরিবেশের ওপর ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে এলাকায় পরিযায়ী পাখি কমে গেছে, সেখানে জলাভূমির উৎপাদনশীলতা নেমে এসেছে। মাছের বংশবৃদ্ধি কমে গেছে। প্রকৃতিতে প্রতিটি প্রাণ তার নিজের ভূমিকা পালন করে; এক ফোঁটা ভারসাম্য নষ্ট হলে পুরো পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন অতিথি পাখিদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। শীত দেরিতে আসে, কখনও খুব দ্রুত চলে যায় ফলে তাদের পরিযান সময় নষ্ট হয়। জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস এসব কারণে অনেক প্রজাতি বিপন্ন হওয়ার পথে। হাওর অঞ্চলের অনেক জায়গায় এখন পানির গভীরতা কমে গেছে। আগের মতো খাদ্য পায় না পাখিরা। ফলে কিছু প্রজাতি ক্রমেই পথ হারাচ্ছে। এই হারিয়ে যাওয়া আসলে এক দেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের সংকেত।

অতিথি পাখি আমাদের শেখায় যাত্রার পথ যতই কঠিন হোক, নিজের ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার আশা হারাতে নেই। তারা শেখায় প্রকৃতি আমাদের সম্পদ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানেই সৌন্দর্য। বাংলাদেশে এখন অনেক অঞ্চলেই মানুষ সচেতন হচ্ছে। স্থানীয়রা পাখি রক্ষায় পাহারা দেয়, শিক্ষার্থীরা ভিডিও ও ছবি দিয়ে সচেতনতা ছড়ায়, বিভিন্ন সংগঠন ক্যাম্পেইন চালায়। এসব উদ্যোগ আশা জাগায় মানুষের হৃদয়ে প্রকৃতির প্রতি মায়া এখনো আছে। শীত এলেই অতিথি পাখিদের আগমনে আমাদের দেশের প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও সমৃদ্ধ, আরও জীবন্ত। তাদের আগমন আমাদের মনে করিয়ে দেয় এ পৃথিবী শুধু মানুষের না; এটি সবার। 

যদি আমরা জলাভূমি রক্ষা করি, শিকার বন্ধ করি, পরিবেশ সংরক্ষণ করি তাহলে আগামী বছরও তারা ফিরে আসবে। আবারও আকাশে দেখা যাবে ঠান্ডা শেপে উড়ে আসা সেই সৌন্দর্যময় সারি। আবারও ভোরের কুয়াশায় ভেসে আসবে তাদের ডানা মেলার সুর। আমরা যদি প্রকৃতিকে সামান্য ভালোবাসা দিই, সে আমাদের ফেরত দেয় অনন্ত সৌন্দর্য। অতিথি পাখিরা সেই সৌন্দর্যেরই দূত যারা প্রতি শীতে এসে আমাদের দেশে এনে দেয় জীবনের আরেক নতুন ছন্দ। 

লেখক 

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/151043