অতিরিক্ত গরম চা-কফি কি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়?
ফুটন্ত গরম চা বা কফি একচুমুকে খাওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। অনেকেই মনে করেন, গরম পানীয় ঠান্ডা করে খাওয়ার কোনও মানে নেই। কিন্তু এই অভ্যাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে-অতিরিক্ত গরম পানীয় কি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়? চিকিৎসাবিজ্ঞান কী বলছে এ বিষয়ে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়। যেকোনো পানীয়ের তাপমাত্রা যদি ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৪৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি হয়, তবে নিয়মিতভাবে তা পান করলে খাদ্যনালির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় খাদ্যনালির ক্যানসারকে বলা হয় ইসোফেজাল ক্যানসার। অতিরিক্ত গরম পানীয় খাদ্যনালির ভেতরের সংবেদনশীল আবরণকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘদিন ধরে এমন ক্ষত তৈরি হতে থাকলে সেখানে কোষের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ে, যা একসময় ক্যানসারের দিকে যেতে পারে।
তবে শুধু গরম পানীয় খেলেই যে এ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝুঁকির বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করে একজন ব্যক্তি দিনে কতবার, কতটা গরম পানীয় পান করছেন এবং সেই সঙ্গে ধূমপান বা মদ্যপানের মতো অভ্যাস রয়েছে কি না, তার উপর।
২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারসহ একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত গরম পানীয় মানবদেহের জন্য সম্ভাব্য কার্সিনোজেনিক হতে পারে। তবে বিষয়টি পানীয় কতটা গরম এবং তা থেকে খাদ্যনালিতে কী ধরনের ক্ষত তৈরি হয়েছে তার উপর নির্ভর করবে।
ক্যানসারের সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক যেমন
অতিরিক্ত গরম পানীয় আমাদের জিভ ও মুখগহ্বর কিছুটা মানিয়ে নিতে পারলেও খাদ্যনালির ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, মুখ থেকে পাকস্থলীতে পৌঁছনোর পুরো পথজুড়ে খাদ্যনালির ভেতরের আস্তরণ অত্যন্ত সংবেদনশীল।
ফুটন্ত বা খুব বেশি গরম পানীয় পান করার সময় খাদ্যনালির যে অংশ দিয়ে সেই তরল প্রবাহিত হয়, সেখানে বারবার তাপজনিত ক্ষত তৈরি হয়। এই অতিরিক্ত তাপে খাদ্যনালির লাইনিং পুড়ে যেতে পারে, যার ফলে শুরু হয় প্রদাহ, জ্বালা ও অস্বস্তি।
এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে গিয়ে শরীর সেখানে দ্রুত কোষ বিভাজন শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এমন ক্ষত ও পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকলে কোষ বিভাজনের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর ফলেই ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক কোষ তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে ইসোফেজাল ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
প্রাণীর শরীরে চালানো একাধিক গবেষণা এবং মানবদেহভিত্তিক পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত অতিরিক্ত গরম পানীয় পান করার অভ্যাস খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে যখন এর সঙ্গে ধূমপান বা মদ্যপানের মতো অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস যুক্ত হয়, তখন আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।
ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে গরম পানীয় পান করা বন্ধ করে দেবেন-
এই প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতামত একেবারেই স্পষ্ট-গরম পানীয় পুরোপুরি বন্ধ করার প্রয়োজন নেই, তবে তা পানের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা মানা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত গরম চা বা কফিতে চুমুক দেওয়া এড়িয়ে চলাই সবচেয়ে নিরাপদ। গ্যাস বা কেটলি থেকে কাপে ঢালার পর অন্তত ৩-৫ মিনিট অপেক্ষা করলে পানীয়ের তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে নেমে আসে, যা খাদ্যনালির জন্য তুলনামূলকভাবে সহনীয়।
এছাড়া গরম পানীয় পান করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, গরম পানীয় সরাসরি গলায় যাতে না যায়। পানির মতো একবারে অনেকটা না খেয়ে, ধীরে ধীরে ছোট ছোট সিপে পান করাই ভালো। এতে খাদ্যনালির ওপর তাপজনিত চাপ কম পড়ে।
চিকিৎসকরা আরও সতর্ক করে বলছেন, খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ধূমপান ও বড় ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত গরম পানীয়ের সঙ্গে যদি এই অভ্যাসগুলো যুক্ত থাকে, তাহলে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই ক্যানসারের আশঙ্কা কমাতে হলে ধূমপান থেকে বিরত থাকাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সচেতনভাবে ও ধীরে গরম পানীয় পান করলেই উপভোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সূত্র: আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার, হেলথলাইন
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/150828