এজেন্টিক এআই থেকে কোয়ান্টাম চ্যালেঞ্জ

 এজেন্টিক এআই থেকে কোয়ান্টাম চ্যালেঞ্জ

মোঃ রেজাউল করিম রাজু :  আমরা যখন ২০২৫-এর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আগামীর দিকে তাকাই, তখন এটি স্পষ্ট যে প্রযুক্তি আর কোনো ধীরগতির বিবর্তন নয়, বরং একটি ক্ষিপ্রগতির বিপ্লব। মাত্র এক বা দুই বছরের ব্যবধানে প্রযুক্তির সংজ্ঞাও আমূল বদলে যাচ্ছে। ২০২৬ সালকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা দেখছেন ‘এজেন্টিক এআই’, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বাস্তবিক প্রয়োগ এবং সাইবার নিরাপত্তার এক মহাযুদ্ধের বছর হিসেবে। 

১. জেনারেটিভ থেকে ‘এজেন্টিক’ এআই : গত কয়েক বছরে আমরা চ্যাটজিপিটি বা মিডজার্নির মতো ‘জেনারেটিভ এআই’ এর সাথে পরিচিত হয়েছি, যা মূলত টেক্সট বা ছবি তৈরি করতে পারে। তবে ২০২৬ সালে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি ‘এজেন্টিক এআই’-এর যুগে।

কীভাবে কাজ করে?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বর্তমানের এআই আপনাকে পরামর্শ দেয়, কিন্তু ২০২৬-এর এআই আপনার হয়ে কাজ করে দেবে। একে বলা হচ্ছে ‘অটোনোমাস এজেন্ট’। ধরুন, আপনি কোথাও ভ্রমণে যাবেন। বর্তমানে আপনি এআইকে জিজ্ঞেস করেন সেরা হোটেল কোনটি। ২০২৬-এর এজেন্টিক এআই আপনার বাজেট, পছন্দ এবং সময় মিলিয়ে নিজেই হোটেল বুক করবে, বিমানের টিকিট কাটবে এবং ক্যালেন্ডারে মিটিং রি-শিডিউল করে দেবে।

বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং এবং কর্পোরেট সেক্টরে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কাস্টমার সাপোর্ট, ডেটা এন্ট্রি বা প্রাথমিক কোডিংয়ের কাজগুলো এআই এজেন্টরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করবে। ফলে মানুষের ভূমিকা হবে তখন ‘সুপারভাইজার’ বা তদারককারীর।

২. স্পেশিয়াল কম্পিউটিং ও মেটাভার্সের নতুন রূপ : ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি মিলে তৈরি করছে ‘স্পেশিয়াল কম্পিউটিং’ । ২০২৬ সালে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের স্ক্রিনের সীমাবদ্ধতা ভেঙে ডিজিটাল কন্টেন্ট আমাদের বাস্তব জগতের সাথে মিশে যাবে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন আর্কিটেক্ট তার ডিজাইন করা বিল্ডিংয়ের থ্রি-ডি মডেল টেবিলে রেখে ক্লায়েন্টকে দেখাতে পারবেন কোনো মনিটর ছাড়াই, কেবল স্মার্ট চশমার মাধ্যমে। শিক্ষা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা প্রবল। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল মানবদেহে অস্ত্রোপচারের প্র্যাকটিস করতে পারবেন, যা বাস্তব ঝুঁকি কমাবে।

৩. হাইপার-কানেক্টিভিটি: সিক্স-জি এবং স্যাটেলাইট ইন্টারনেট : ২০২৬ সাল নাগাদ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সিক্স-জি প্রযুক্তির ট্রায়াল শুরু করবে। যদিও বাংলাদেশে ফাইভ-জি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হতে সময় নিচ্ছে, তবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট (যেমন স্টারলিংক বা এর প্রতিদ্বন্দ্বীরা) গেম চেঞ্জার হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের দুর্গম চরাঞ্চল বা পাহাড়ি এলাকাতেও গিগাবিট গতির ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে ডিজিটাল অর্থনীতির সাথে যুক্ত করবে।

৪. সাইবার নিরাপত্তা: ২০২৬ সালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ : প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে নিরাপত্তার ঝুঁকিও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। ২০২৬ সালে সাইবার নিরাপত্তা হবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়।

ক. এআই চালিত সাইবার আক্রমণ : হ্যাকাররা এখন আর ম্যানুয়ালি কোড লিখে হ্যাক করে না। তারা এআই ব্যবহার করে নিমিষেই হাজার হাজার ফিশিং ইমেল বা ম্যালওয়্যার তৈরি করছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি ডিপফেকের মাধ্যমে প্রতারণা বাড়ছে। ২০২৬ সালে ভয়েস ক্লোনিং বা ভিডিও ডিপফেক এত নিখুঁত হবে যে, আসল ও নকলের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়বে।

খ. কোয়ান্টাম থ্রেট : কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ সুপারকম্পিউটারের চেয়ে কোটি গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে। ভয়ের বিষয় হলো, বর্তমানের ব্যাংকিং এনক্রিপশন ভাঙতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগতে পারে। তাই ২০২৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে ‘পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি’ বা পিডিকিউ নিয়ে কাজ জোরদার হবে।
নিরাপত্তায় করণীয়:
জিরো ট্রাস্ট পলিসি : কোনো ডিভাইস বা ব্যবহারকারীকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা। প্রতি ধাপে ভেরিফিকেশন।
বায়োমেট্রিক বিবর্তন: শুধু পাসওয়ার্ড নয়, আচরণগত বায়োমেট্রিক্স (যেমন টাইপিং স্পিড, হাঁটার ধরন) দিয়ে আইডেন্টিটি ভেরিফাই করা হবে।

৫. গ্রিন টেক বা টেকসই প্রযুক্তি : এআই এবং ডেটা সেন্টার প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ করে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি। ২০২৬ সালে প্রযুক্তির অন্যতম ফোকাস হবে ‘সাসটেইনেবল টেক’ বা টেকসই প্রযুক্তি। নতুন প্রজন্মের সলিড-স্টেট ব্যাটারি ইলেকট্রিক গাড়ির রেঞ্জ দ্বিগুণ করবে এবং চার্জিং সময় কমিয়ে আনবে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির সাথে স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা থেকে দীর্ঘমেয়াদী মুক্তি মিলতে পারে।


ক্যারিয়ার গাইডলাইন: যারা এখন প্রযুক্তি খাতে ক্যারিয়ার গড়তে চাইছেন বা পড়াশোনা করছেন, তাদের জন্য ২০২৬ সালের বাজার হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গতানুগতিক স্কিল দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হবে। নতুনদের জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ:

১. এআই-এর সাথে কাজ করা শিখুন : কোডিং জানাই যথেষ্ট নয়, এআই টুল ব্যবহার করে কীভাবে দ্রুত কোড করা যায়, তা শিখতে হবে। ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে সরে এসে ‘মডেল টিউনিং’ বা এআই ইথিক্স নিয়ে পড়াশোনা করুন।

২. সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা প্রাইভেসি: আগামী ৫ বছরে সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্টদের চাহিদা আকাশচুম্বী হবে। ইথিক্যাল হ্যাকিং, ক্লাউড সিকিউরিটি এবং ডেটা কমপ্লায়েন্স নিয়ে দক্ষতা অর্জন ক্যারিয়ারের জন্য নিরাপদ বাজি।

৩. সফট স্কিল ও অ্যাডাপ্টেবিলিটি: এআই যখন টেকনিক্যাল কাজগুলো করে দেবে, তখন মানুষের ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’, ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’ এবং ‘সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’-র কদর বাড়বে। মেশিন যা পারে না, আপনাকে তাই পারতে হবে।

৪. স্পেশালাইজেশন: জেনারেল আইটি নলেজের চেয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে (যেমন- ব্লকচেইন, আইওটি, বা রোবোটিক্স) গভীর জ্ঞান অর্জন বেশি ফলপ্রসূ হবে।

২০২৬ সাল আমাদের সামনে এক অবারিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে, একই সাথে ছুঁড়ে দিচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। একদিকে যেমন ক্যান্সার শনাক্তকরণে এআই বিপ্লব ঘটাবে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি একটি ‘ডাবল এজড সোর্ড’ বা দুধারী তলোয়ার। আমরা যদি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সঠিক দক্ষতায় গড়ে তুলতে পারি এবং সাইবার নিরাপত্তার অবকাঠামো শক্তিশালী করতে পারি, তবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কেবল স্লোগান নয়, বাস্তবে রূপ নেবে।

প্রযুক্তি আমাদের ভৃত্য, মনিব নয়—এই দর্শন মাথায় রেখেই আমাদের ২০২৬-এর প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতে হবে। নতুন যারা এই জগতে আসছেন, তাদের মনে রাখতে হবে পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব সত্য, আর সেই পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াই হলো প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা।

 

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/150777