ইসলামী আইনে হত্যাচেষ্টার শাস্তি কি?

ইসলামী আইনে হত্যাচেষ্টার শাস্তি কি?

মানুষের জীবন আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া এক পবিত্র আমানত। এই আমানতের ওপর আঘাত মানে শুধু একজন মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়; এটি আল্লাহর নির্ধারিত সীমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। অথচ সময়ের নির্মম বাস্তবতা হলো—আজ মানুষের জীবন নিরাপদ নয়। তুচ্ছ কারণেও মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, কিংবা তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পবিত্র আল-কোরআন মানবজীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে হত্যার বদলা ছাড়া কিংবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ৩২)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, একটি প্রাণের নিরাপত্তা মানেই গোটা সমাজের নিরাপত্তা। আর সেই নিরাপত্তার ওপর প্রথম আঘাত আসে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে। কারণ হত্যার চেষ্টা মানেই জীবনের মর্যাদা অস্বীকার করা। ইসলাম তাই হত্যার আগেই তার পথ বন্ধ করতে চায়।

আধুনিক আইনি ব্যবস্থায় অনেক সময় অপরাধকে ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু ইসলাম এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সংশোধন করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব কাজের মূল্যায়ন হয় নিয়তের ভিত্তিতে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ১)

ফিকহবিদদের মতে, অপরাধ সংঘটনের জন্য তিনটি উপাদানই যথেষ্ট—নিয়ত, উপকরণ ও প্রচেষ্টা। হত্যাচেষ্টায় এই তিনটি উপাদানই বিদ্যমান থাকে। ফলে এটি কোনো অসম্পূর্ণ অপরাধ নয়; বরং একটি পূর্ণ নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ।

নবী (সা.) মানুষের ভেতরের সহিংস মানসিকতাকেও অপরাধের আওতায় এনেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন দুই মুসলমান অস্ত্র হাতে মুখোমুখি হয়, তখন হত্যাকারী ও নিহত উভয়েই জাহান্নামি।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘নিহতও হত্যা করতে উদগ্রীব ছিল।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)

ইসলাম অপরাধ দমনে প্রতিরোধমূলক ন্যায়বিচার অনুসরণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে, ফেরেশতারা তাকে অভিশাপ দেয়।’ (সহিহ মুসলিম) অর্থাৎ হত্যার আগুন স্ফুলিঙ্গ অবস্থাতেই নেভাতে হবে।

ফকিহ আলেমরা হত্যাচেষ্টাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করেছেন—সরাসরি প্রাণনাশের চেষ্টা, পরিকল্পিত হামলা ও ষড়যন্ত্র এবং সম্মিলিত হত্যাচেষ্টা। ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘যদি নিয়ত ও উপকরণ পূর্ণ থাকে, তবে অপরাধ সম্পন্ন না হলেও শাস্তি বৈধ।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া)

শরিয়তের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্যের একটি হলো প্রাণ সংরক্ষণ। হত্যাচেষ্টাকে হালকাভাবে দেখলে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, প্রতিশোধ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং আইন অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই ইসলাম এখানে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

হত্যা সংঘটিত না হলে কিসাস কার্যকর হয় না—এ বিষয়ে ফকিহদের ঐকমত্য রয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে অপরাধী শাস্তিমুক্ত থাকবে। এ ক্ষেত্রে তাজির শাস্তি প্রযোজ্য হয়, যা রাষ্ট্র বা আদালত নির্ধারণ করে। অপরাধের ভয়াবহতা ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেতে পারে।

ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হত্যার চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয় না, তার শাস্তি এমন হওয়া উচিত যাতে সে নিজে ও অন্যরা ভবিষ্যতে এই অপরাধে সাহস না পায়।’

হত্যাচেষ্টায় যদি অঙ্গহানি বা স্থায়ী জখম ঘটে, তবে কিসাস প্রযোজ্য হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জখমের বদলে অনুরূপ জখম।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ৪৫)

অর্থাৎ হত্যা না হলেও শারীরিক ক্ষতির পূর্ণ বিচার নিশ্চিত করা হবে। ওমর (রা.) বলেন, ‘শাস্তিতে শৈথিল্য সমাজকে ধ্বংস করে।’ (মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা)

এ ধরনের অপরাধে পার্থিব শাস্তির পাশাপাশি পরকালেও কঠিন জবাবদিহি রয়েছে। তবে ইসলামের সৌন্দর্য হলো—এমন অপরাধীর জন্যও তাওবার দরজা খোলা থাকে।

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/150499