বগুড়া মুক্ত দিবস : তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও আজ উল্লেখযোগ্য এলাকা হানাদারমুক্ত হয়
স্টাফ রিপোর্টার : স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বগুড়া জেলা সদর মুক্ত হওয়ার তারিখ নিয়ে মতভেদ চলছেই। তৎকালীন বগুড়া শহরের বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিনটি নিয়ে পৃথক পৃথক তারিখ উল্লেখ করেছেন। মতভেদ যাই হোক না কেন ১৯৭১ সালের এই দিনে বগুড়ার উল্লেখযোগ্য এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যমতে ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া মুক্ত দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
আবার এই দিনটি ঘিরে বগুড়ার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট কাগজ পত্র, দলিল পত্র ইত্যাদিতেও সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত করা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার ভাষ্যমতে ১৩ ডিসেম্বর শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণের মধ্য দিয়ে বগুড়াকে হানাদারমুক্ত করা হয়।
এর আগে টানা তিন দিন মিত্রবাহিনীর সহায়তায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি ধরে যুদ্ধ করেন। বগুড়া বাংলাদেশের একমাত্র জেলা,যেটি দখল নিতে পাক বাহিনীর সময় লেগেছিল ২৩ দিন। এরপর নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে পাক বাহিনীর বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রির পর দেশে সশস্ত্র হামলা শুরু হয়।
এদেশের মানুষকে হত্যা এবং নি:শেষ করে দেয়ার জন্য ২৬ মার্চ সকালে রংপুর থেকে পাকিস্তানী বাহিনী সড়ক পথে এসে বগুড়া দখল নিতে আক্রমণ চালায়। টানা পাঁচ দিন যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে বগুড়া থেকে হটিয়ে দিতে ওই দিন আজাদ, টিটু, তোতা, তারেকসহ প্রায় ৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে ১৭ এপ্রিল সড়ক এবং আকাশ পথে হামলা চালিয়ে আবারও বগুড়ার দখল নেয় পাকিস্তানী বাহিনী।
এরপর থেকেই বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় পাকহানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড। বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প করে এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় তারা শহরের ফুলবাড়ি, রেলস্টেশন, কৈচর, রামশহর পীরবাড়ি ও নারুলী বধ্যভূমিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় এমন নির্যাতন ও নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছিল যে তা দেখে তারা শিউরে উঠতো বহু বছর পরও।
এছাড়াও বিজয় দিবসের মাত্র একমাস আগে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া শহীদনগর এলাকা থেকে ১১ নভেম্বর ১৪ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে বগুড়ার শাজাহানপুরের বাবুর পুকুর এলাকায় গুলি করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোর থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়াকে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধারা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নওদাপাড়া, চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামারা এলাকায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন্ট রেজিমেন্টের বিগ্রেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহের নেতৃত্বে ট্যাংক নিয়ে তারা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্থানীয়রাও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন্ট রেজিমেন্টের বিগ্রেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেমা সিং এক বিগ্রেড সেনা নিয়ে বগুড়া শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া, চাঁদপুর, ও ঠেঙ্গামারা গ্রামের কাছাকাছি লাঠিগাড়ী নামক স্থানে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দলটি ক্ষেতলাল উপজেলা দিয়ে সান্তাহার হয়ে কাহালু দিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে আসেন। মিত্র বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার সিও কর্ণেল দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটি দল দক্ষিণ দিকে সুখানপুকুর, গাবতলী হয়ে বগুড়া পুলিশ লাইন্সের কাছে ঢাকা বগুড়া মহাসড়কে ৭৬টি অত্যাধুনিক ট্যাংক নিয়ে অবস্থান নেন। এই দলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হোসেন তারেক।
এদিকে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল লছমন সিং ছিলেন পুরো উত্তারাঞ্চলের দায়িত্বে। সে সময় শহরের বিভিন্ন দিক থেকে ঢোকা মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি আজিজুল হক কলেজ পুরাতন ভবন, টেকনিক্যাল কলেজ, ফুলবাড়ি ও মাটিডালিতে পাকবাহিনীর সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তবে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পরে এ দিন দুপুরে ফুলবাড়ী এলাকার পাশে শহরের বৃন্দাবন পাড়া এলাকায় পাক বাহিনীর প্রায় ৭০০ সৈন্য অস্ত্রসহ মিত্রবাহিনীর ৬৪ মাউনটেন্ট রেজিমেন্টের বিগ্রেডিয়ার প্রেম সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সৈন্যবাহিনীকে বন্দী করে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ে মিত্র বাহিনীর হেফাজতে রাখা হয়। এরকম খন্ড খন্ড যুদ্ধ চলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত।
পরের দিন ভোর থেকেই মিত্রবাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া শহরের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হয়। পরাস্ত হয় হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার প্রথম লাল সবুজ পতাকা সাতমাথার গোল চত্ত্বরে ওড়ানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৩৫ বছর পর ২০০৫ সালে শহরের ফুলবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের স্মরণে মুক্তির ফুলবাড়ি নামে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/149956