শীত আসুক মানবতার সেবায়

শীত আসুক মানবতার সেবায়

হেমন্তের নরম রোদের সাথে হঠাৎ করে বাতাসে মিশে যাচ্ছে অচেনা শীতলতা। ভোরের শিশিরে ভিজে যাচ্ছে মাটির গন্ধ, সূর্যের আলো আর তেমন উজ্জ্বল নয় নরম, মলিন, সোনালি। কুয়াশায় ঢাকা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন কোনো অজানা সুরে গুনগুন করে শীতের আগমনের বার্তা দিচ্ছে। এভাবেই শীত নেমে আসছে আমাদের জীবনে নরমে, নিঃশব্দে, অথচ গভীর উপস্থিতি নিয়ে। কারও কাছে এটি আনন্দের ঋতু, কারও কাছে এটা কষ্ট ও লড়াইয়ের মাধ্যমে বেঁচে থাকার আরেক নাম। 

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে শীত মানেই সকালবেলায় খড়ের আগুনে হাত সেঁকানো, গরম চায়ের কাপ হাতে গল্প, আর কৃষকের ধানের মৌসুমের পর কিছুটা স্বস্তি। শীতকাল মানেই নানা রকম সুস্বাদু পিঠা-পুলি ও টাটকা শাকসবজির ঋতু। এ সময়ে খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে তৈরি ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। এছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় লোকজ মেলার আয়োজন হয় এবং ফসল তোলার উৎসব (নবান্ন) পালিত হয়, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পিকনিকের আয়োজন হয়, ব্যাডমিন্টন, দাড়িয়াবান্ধা, কাবাডি খেলার মত লোকজ খেলার হিড়িক পড়ে। এভাবেই শীত আনন্দ-উৎসব ও প্রকৃতির উপভোগের স্বর্গীয় আনন্দ বয়ে আনে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের জন্য। কিন্তু এই শীতই আবার সমাজের আরেক শ্রেণির মানুষের জন্য বয়ে আনে ভিন্ন চিত্র। 

কথায় আছে, “কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।” শীতের আনন্দের ঋতু কারও জন্য সুখের, আবার কারও জন্য এক কঠিন সংগ্রাম। যাদের নিজের মাথার উপরে ছাদ নেই, রাস্তার পাশে, রেলস্টেশনে বা অস্থায়ী আশ্রয়ে রাত কাটে, তাদের কাছে শীত মানে আতঙ্ক। এই মানুষদের শীতের পরিচর্যা করার সামর্থ্য নেই। ধনীদের মতো রঙ-বেরঙের বা ডিজাইনের উষ্ণ পোশাক তাদের নেই। ঘুমানোর সময় কম্বল তো দূরের কথা, শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামান্য পোশাকটুকুও তাদের হাতে নেই। সকালে চায়ের কাপ কিংবা ধনীদের মতো শীতের পিঠাপুলি খাওয়ার সৌভাগ্যও তাদের হয় না। শীতের এই দুর্বিষহ জীবন সবচেয়ে বেশি কঠিন হয়ে পড়ে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য। ঠান্ডা, সর্দি, কাশি এবং নানা রোগ তাদের শরীরে বাসা বাঁধে। অনেকের ক্ষেত্রে ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়া হয়ে যায়। রাতের আঁধারে তারা কাশতে কাশতে রাত পার করে, অথচ দেখার কেউ নেই, যত্ন করার কেউ নেই এবং ঔষধ কিনে খাওয়ারও সামর্থ্য নেই। শীত শুধু মানুষের জীবনকেই কঠিন করে তোলে না, অন্যান্য প্রাণী কুকুর, বিড়ালও শীতের কঠোরতার শিকার হয়। তারা কষ্ট পায়, কিন্তু নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না। তাদের কাছেও শীত আনন্দের মুহূর্ত বয়ে আনে না। আর তাদের কাছেই শীত উপভোগের চেয়ে শীতের বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠা আনন্দের। 

তাই তাদের এই দুর্বিষহ জীবনে আসুন আমরা যে যার জায়গায় তাদের পাশে দাঁড়াই। যদিও আমরা প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না, তবু আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হতদরিদ্রদের কষ্ট লাঘব করার দায়িত্ব আছে। বিত্তবানরা তাদের কম্বল, উষ্ণ কাপড়, ঔষধ কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।এছাড়া ভোরবেলা বা রাতের সময়ে গরম চা, খাবার বা সুষম খাদ্য বিতরণ করলে শীতের তীব্রতা কিছুটা কমানো সম্ভব। শীতজনিত রোগ থেকে বাঁচাতে ঔষধ, ভ্যাকসিন বা স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ।শুধু মানুষের প্রতি সহায়তা নয়, পথের প্রাণীর সুরক্ষাও জরুরি। রাস্তাঘাটে থাকা কুকুর, বিড়াল বা অন্যান্য প্রাণীর জন্য খাবার ও উষ্ণ আশ্রয় নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। পোষা প্রাণীর জন্য গৃহস্থলে উষ্ণ স্থান তৈরি করা যেতে পারে।শীতকালীন সহায়তা শুধুমাত্র বিতরণ নয়, সচেতনতা সৃষ্টি করাও জরুরি। সমাজে শীতকালীন অসহায়দের প্রয়োজন সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং প্রতিবেশী বা কমিউনিটির সঙ্গে মিলিত হয়ে সহায়তা কার্যক্রম চালানো আমাদের মানবিক দায়িত্বকে শক্তিশালী করে। শীত কেবল ঋতু নয়, এটি আমাদের সহমর্মিতা, দয়া এবং মানবতার মূল্য প্রমাণ করার সময়।তাই এবারের শীত আসুক মানবিকতার অনুশীলনের সময় হিসেবে যেখানে আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাধ্যমে জয়ী হই।

লেখক

সাদিয়া আফরিন

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/149159