গণতন্ত্র উত্তরণের সন্ধিক্ষণে তোমাকে বড় বেশি প্রয়োজন
বাংলাদেশের সাবেক তিন তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী, গণমানুষের নেত্রী,বিএনপির চেয়ারপার্সন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলেই হাত কাঁপে, কোনটা লিখতে কোনটা লিখি, আবার কোনটা বাদ পড়ে যায় এই ভয়ে। পাশাপাশি সীমাবদ্ধ অক্ষর দিয়ে তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই লেখা যাবে না, কারণ তাঁর দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময়ের সংগ্রামী জীবনের চুলচেরা লিখতে গেলে একটি মহাকাব্য রচনা হয়ে যাবে, সুতরাং ইচ্ছে করলেই তাঁর সম্পর্কে সবকিছু লেখা যায় না, তারপরেও ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকেই যাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরিকে মহাসমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন, তিনি বলেছেন; “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারে যে,সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মত চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে......।” ঠিক তেমনি একজন আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মহাসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করলে মোটেই অত্যুক্তি করা হবে না। তিনি ছিলেন মহাসমুদ্রের মত বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মহীয়সী নারী। হিংসা বিদ্বেষ তাঁকে স্পর্শ করেনি। বাংলাদেশের মানুষের জন্যে তাঁর ত্যাগ অতুলনীয়। রাজনীতি করার কারণে তাঁর স্বামীকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে, বিনা চিকিৎসায় হারিয়েছেন কোলের আদরের সন্তান আরাফাত রহমান কোকোকে। মায়ের কোলে সন্তানের লাশ, জাতির জন্যে এটা কম ত্যাগের কথা নয়,অনেকের পক্ষেই এই ত্যাগ স্বীকার করা বড় কঠিন।
রান্নাঘরের একজন সলজ্জ গৃহবধূ থেকে বেগম খালেদা জিয়া কিভাবে একটি দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিলেন সেটাও ছিল একটি কষ্টের উপাখ্যান, বহু কষ্ট করতে হয়েছে তাঁকে। স্বৈরাচারের বুলেট, ঝাঁঝালো টিয়ারসেল, সহ্য করে এবং জীবন বাজি রেখে আপসহীন নেত্রী হয়েছিলেন তিনি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সনে চট্টগ্রামে কতিপয় বিপথগামি সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হওয়ার পর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া ও রক্তভেজা নবগঠিত দল বিএনপি, দলের প্রসার তখনও তেমন নাই, উপরšুÍ জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর স্বার্থান্বেষী অনেক নেতা দল ছেড়ে চলে গেছেন। কে ধরবে বিএনপির হাল, কে এই দলটাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়ে সার্বজনীন দলে পরিণত করবেন তার কোন লোক ছিল না, এই বিষয় নিয়ে দলের তৎকালিন নীতি-নির্ধারকদের মাঝে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছিল তখন কতিপয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে দলের হাল ধরার জন্যে অনুরোধ করলে তিনি অবশেষে রাজি হন এবং বিএনপির মত একটি নব গঠিত দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সনের নীলনক্সার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে পাহাড়ের মত অবিচল দাঁড়িয়ে থাকেন অকুতোভয় এই নেত্রী। নানা লোভ লালসাও তাঁকে পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে পারেনি। তিনি বাংলার মানুষের কাছে আপসহীন নেত্রী হয়ে উঠেন। রক্ত মাংসের মানুষ নানা লোভে নানা প্রলোভনে অনেক সময় মানুষ পথচ্যুত হয়ে যায়, কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া একটুও পথ হারাননি। এই রকম একজন নেত্রীকে দলে পাওয়া কম ভাগ্যের কথা নয়, একজন খালেদা জিয়াকে তৈয়ার করতে জাতিকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি এক সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৯১ সনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে নির্বাচন আদায় করে ছাড়েন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকার গঠন করেন। সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনা দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন একদিনও শান্তিতে থাকতে দিব না, আসলে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দেননি। ২০০৮ সনে একটি পরিকল্পিত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সমস্ত কিছু উলোট-পালট করিয়া ফেলেন। তারপরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। একটি সাজানো মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়। একজন অসুস্থ বয়স্কা মহিলাকে পাঁচ বছরের সাজা মামলায়ও জামিন দেওয়া হয় না। কারাগারের স্যাঁতসেঁতে ঘরে দিনের পর দিন বন্দি করে রেখে তিল তিল করে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করা হয়। যে নেত্রী গাড়িতে চড়ে জেলখানায় গেলেন সেই নেত্রীকে মাত্র দুই বছরের মাথায় হুইল চেয়ারে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসতে হল। তাহলে কি পরিমাণ অবিচার তাঁর উপর করা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। আইনজীবী সমাজসহ দেশের সকল মানুষ তাঁর চিকিৎসার জন্যে তীব্র আন্দোলন করা সত্ত্বেও সরকার তাঁর চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। আজকে যখন তাঁর চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন দেশে বিদেশে লক্ষ কোটি জনতা তাঁর রোগমুক্তির জন্যে আল্লাহর দরবারে হাত তুলেন। এটা কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়। মানুষ মরণশীল, পৃথিবীতে আসলে তাঁকে যেতেই হবে এটাই নিয়তি, আজ যাদের কারণে বেগম খালেদা জিয়ার এই অবস্থা তাদেরকে জাতি কোন দিন ক্ষমা করবে না। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল, “মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।” আজ বেগম খালেদা জিয়ার জন্যে লক্ষ কোটি মানুষের চোখের জল অবিরত ঝরছে, কোটি কোটি হাত তাঁর রোগমুক্তি কামনা করছে, এর থেকে বড় পাওয়ার আর কিছু নেই।
মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে তিনি টিকে আছেন, তিনি প্রমাণ করেছেন সাধারণ কোন ধাতুতে গড়া নন তিনি, তিনি ফিনিক্স পাখি, যিনি ভস্মের মাঝেও প্রাণের স্পন্দন জিইয়ে রাখতে জানেন, তিনি এক সময় চলে যাবেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মাঝেও এদেশে জন্ম নিবে লক্ষ কোটি খালেদা জিয়া, যাঁরা কোনদিন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবে না। দুঃখ একটাই গণতন্ত্র উত্তরণের সন্ধিক্ষণে তুমি দেশে থাকবে না, এই সময়ে তোমাকে বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
লেখক
এড. মোঃ মোজাম্মেল হক
উপদেষ্টা, বগুড়া জেলা বিএনপি।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/149140