নগরীতে সবুজায়ন হ্রাসে মানসিক স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব
সবুজ প্রকৃতিকে করে সুন্দর ও সমৃদ্ধ। পল্লী-গ্রামে এই সবুজ জনপদকে করেছে বাসযোগ্য। সবুজের সমারোহ সর্বত্র শোভনীয়। প্রকৃতির পূর্ণাঙ্গতার জন্য সবুজায়ন অত্যাবশ্যক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবুজ শ্যামলিমার আধিক্য সহজেই হয়ে থাকে। মুক্ত খোলা মেলা পরিবেশে বিচিত্র উদ্ভিদরাজির বেড়ে ওঠা স্বভাবতই গ্রাম-বাংলার জনপদকে মনোরম করে তোলে। কিন্তু শহরে এর ব্যত্যয় ঘটে। শহর বা নগরে ইট-পাথরের কাঠখট্টা পরিবেশে সবুজ উদ্ভিদগুলো সুস্থ অনুকূল পরিবেশ পায় না। ফলে দিনে দিনে নগর বা শহরের পরিবেশ হয়ে উঠছে অসহনীয়।
নগরায়ণের দ্রুত বিস্তার আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই বাস্তব চিত্র। উন্নয়ন ও আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় শহরগুলো পরিণত হচ্ছে কংক্রিটের বনে। বহুতল ভবন, সড়ক সম্প্রসারণ, বাণিজ্যিক স্থাপনা এসবের চাপে নগরীর খোলা জায়গা ও সবুজ পরিবেশ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত ভারসাম্যকেই বিপর্যস্ত করছে না; মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ফেলছে গভীর প্রভাব। অথচ সুস্থ নগরজীবনের জন্য প্রকৃতির উপস্থিতি ও সবুজ পরিবেশ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বহুবার উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতি মানুষের মনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সবুজ গাছপালা, খোলা স্থান, পার্ক বা নদীকূল এমন পরিবেশ মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, মনকে শান্ত রাখে। কিন্তু বর্তমান নগরজীবনে এই স্বস্তির জায়গাগুলোই ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিগত কয়েক বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে গাছ কাটার হার বেড়েছে। নতুন প্রকল্প, রাস্তাঘাট নির্মাণ, আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি, এসবের কারণে পার্ক, বাগান ও মাঠ ক্রমে হারাচ্ছে। জনসংখ্যার চাপ বাড়ায় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের প্রায় প্রতিটি কোণায় কংক্রিটের ভবন গড়ে তুলছে। ফলে শিশুরা খেলাধুলার জায়গা হারাচ্ছে, বয়স্করা হারাচ্ছে হাঁটার পথ, আর সাধারণ মানুষ হারাচ্ছে ক্ষণিকের স্বস্তির সবুজ ছায়া। সবুজায়ন কমে যাওয়ার ফলে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ, চাপ, ক্লান্তি ও মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। সবুজ গাছপালা বায়ুদূষণ কমায়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং বাতাসের গুণগত মান উন্নত করে। কিন্তু গাছ কমে যাওয়ায় শহরগুলো হয়ে উঠছে ‘হিট আইল্যান্ড’। গরমের তীব্রতা বেড়ে মানুষের শারীরিক অস্বস্তি বাড়ছে। শিশুদের খেলাধুলার জায়গা কমে যাওয়ায় তাদের মানসিক বিকাশেও প্রভাব পড়ছে। কর্মব্যস্ত জীবনযাত্রায় প্রকৃতির সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও নিদ্রাহীনতা, মনোযোগের ঘাটতি এবং হতাশার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া হাঁটাচলার জায়গা না থাকায় ব্যায়ামের অভাব দেখা দিচ্ছে, ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসুখ বাড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা কারণ, সবুজায়ন রক্ষায় এটি সবচেয়ে জরুরি বিষয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট খোলা জায়গা সংরক্ষণ করতে হবে। পার্ক ও শিশুদের খেলার মাঠ সংখ্যা বাড়াতে হবে। সড়কে ছায়া সৃষ্টিকারী বড় গাছ রোপণ করা জরুরি। নতুন নির্মাণ কাজে গাছ কাটার পরিবর্তে বিকল্প নকশার প্রচলন করতে হবে। ছাদবাগান, বারান্দাবাগান এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক বাগান প্রকল্পে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সবুজ শুধু চোখের আরাম নয়; এটি মানসিক সুস্থতার এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। নগরবাসীর সুস্থ ও প্রাণবন্ত জীবনের জন্য তাই সবুজায়নের পুনর্জাগরণ আজ সময়ের দাবি।
লেখক
জান্নাতুল ফেরদাউস অহনা
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।