বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন সংগ্রামী এক কিংবদন্তী
বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কিছু নাম ও ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের উপস্থিতি কেবল রাজনৈতিক পদমর্যাদার কারণে নয় বরং তাদের ব্যক্তিত্ব, সংগ্রাম, দৃঢ়তা, ত্যাগ ও সময়কে রূপান্তর করার ক্ষমতার কারণে। সেই নামগুলোর একটি হলো বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর জীবন যেন এক অদম্য পথচলার কাহিনী। যেখানে দায়িত্বের ডাক এসেছে বারবার, আর প্রতিবারই তিনি সেই ডাক গ্রহণ করেছেন নির্ভীকভাবে, কোন অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করে। একদিকে পরম ব্যক্তিগত শোক, অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব সবকিছু মিলিয়ে তাঁর পুরো জীবন এক বিরল সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী।
আমরা সেই সংগ্রামী জীবনের পথচলার কথা বলছি, সেই নারীর কথা বলছি, যিনি রাজনীতিতে আসেননি নিজের ইচ্ছায়, তবুও হয়ে উঠেছেন রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে। যিনি দিয়েছিলেন নেতৃত্বের একটি বিকল্প রূপরেখা, যিনি ছিলেন গণতন্ত্রের উত্থানে দৃঢ় কণ্ঠ, আবার বিপদের সময় হয়ে উঠেছেন জনতার ভরসার প্রতীক। রাজনৈতিক ভিন্নমত সত্ত্বেও তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার কারণ তাঁর সেই অনমনীয়তা, যেটি তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য এক চরিত্রে পরিণত করেছে।
দিনাজপুরের সেই শান্ত গ্রাম থেকে তাঁর জীবনের শুরু। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্ম নেওয়া ছোট্ট মেয়েটির স্বপ্ন নিশ্চয়ই সাধারণ ছিল। সেই সময়ে প্রায় সব বাঙালি পরিবারের মতোই শিক্ষা, মূল্যবোধ ও দৈনন্দিন পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এক শৈশব তাঁর। কিন্তু এই সাধারণ শৈশব একদিন তাকে অতিক্রম করে নিয়ে যাবে এক ব্যতিক্রমী পথের দিকে যেখানে জাতীয় দায়িত্বের কাঁধলাগা, রাজনৈতিক অভিঘাত, জনগণের আস্থা এবং সংগ্রামের ইতিহাস অপেক্ষা করছিল। তখনো কেউ জানত না এই মেয়েটিই দেশের সবচেয়ে আলোচিত নারীদের একজন হয়ে উঠবেন। তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহের মধ্য দিয়ে। তাঁর স্বামী তখন সেনা কর্মকর্তা, পরে স্বাধীনতার ঘোষক, তারপর রাষ্ট্রপতি। এমন এক মানুষ যার জীবনে দায়িত্ব, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম ছিল চালিকাশক্তি। একজন রাষ্ট্রনেতার সহধর্মিণী হিসেবে খালেদা জিয়ার চোখের সামনে খোলা হতে থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার জটিলতা, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দেশের রাজনৈতিক প্রস্তুতির পরিবর্তন। তিনি তখনও রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি, কিন্তু দায়িত্বের চেতনা তাঁর ভেতরে গড়ে উঠছিল নীরবে।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডে একদিকে বিধ্বস্ত হলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, অন্যদিকে দেশেরও রাজনৈতিক ভিত্তিও নড়ে উঠল। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো তখনো বুঝে উঠতে পারেননি দেশ তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছে নতুন দায়িত্বে। বিএনপি তখন নেতৃত্বহীন অবস্থায় বিভক্তির ঝুঁকিতে, দলকে বাঁচাতে এমন একজন দরকার ছিল যিনি গ্রহণযোগ্য, দৃঢ় ও নির্লোভ। নেতাকর্মীদের অনুরোধে সেই ভার তিনি কাঁধে তুলে নিলেন। একটি শোকাহত বিধবা নারী তখন এগিয়ে এলেন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ধর্মের নেতৃত্বে। তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, কিন্তু জাতির সময়ের দাবি তাঁকে এক অনিবার্য সিদ্ধান্তে নিয়ে এলো। সেখানেই শুরু তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক যাত্রা। এমন এক যাত্রা যা ছোট কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তভাবে দাঁড়ানোর লড়াই। তিনি যখন রাজপথে নামলেন, তখন সামরিক শাসনের কঠিন সময়। বিরোধী রাজনীতি ছিল দমনের শিকার, রাজনৈতিক অধিকার সংকুচিত, গণতন্ত্র তো তখন নিছক শব্দমাত্র। ঠিক এমন এক সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন প্রবল বিরোধী কণ্ঠ, নারী হয়েও নয়, বরং নেতা হিসেবে। মানুষ তাঁকে দেখল সংগ্রামের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে, শ্লোগানের ভিড়ে তাঁর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো দৃঢ় বিশ্বাসের ভাষায়।
১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে তাঁর নেতৃত্ব আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ তখন গণতন্ত্রের জন্য তীব্র লড়াই করছিল, আর সেই লড়াইয়ের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন বেগম জিয়া। রাজপথে তাঁর উপস্থিতি মানুষকে সাহস দিত, দলে ঐক্য আনত, রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রবাহিত করত। তিনি হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসেননি, কিন্তু রাজনীতির পরিস্থিতি তাঁকে দ্রুতই পরিণত করে ফেলে নেতৃত্বের দায়িত্বশীল প্রতীকে। প্রতিদিনের আন্দোলন, কর্মসূচি, কর্মীর ওপর নির্যাতন সবকিছু সামলানো আর সংগঠিত করা তাঁর জন্য কঠোর পরীক্ষা ছিল। কিন্তু তিনি টালমাটাল রাজনীতির ভেতরেও নিজের অবস্থান হারাননি।
১৯৯০ সালের গণআন্দোলন ছিল তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। একদিকে বিরোধী জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, অন্যদিকে জনগণের আস্থা ধরে রাখা সব মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। সেই আন্দোলনের সাফল্যে বাংলাদেশ ফিরে পায় গণতন্ত্রের পথ। সামরিক শাসনের অবসান হয়, আবার শুরু হয় নতুন রাজনৈতিক যাত্রা। খালেদা জিয়া তখন আর কেবল দলের চেয়ারপারসন নন তাঁর নাম তখন গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসেও এটি ছিল এক বিরাট ঘটনা। তাঁর নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অন্যতম পরীক্ষা। দেশের রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দিতে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতির অন্যতম ভিত্তি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর প্রথম মেয়াদকাল ছিল পুনর্গঠনের সময়। অর্থনীতি দুর্বল, অবকাঠামো ভঙ্গুর, প্রশাসন অস্থিতিশীল সব মিলিয়ে তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল এক সঙ্কুল পরিবেশ। কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বেসরকারি খাতকে উৎসাহ, কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগ, গ্রামীণ উন্নয়ন এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তারে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁর সময়েই বেসরকারিকরণকে মূলধারা করা হয়, যেটি পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতিতে নব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০০১ সালে আবারও জনমতের আস্থায় দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় ফিরে আসেন। তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে সন্ত্রাস দমন, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রের মূল শক্তি হলো স্থিতিশীলতা—রাজনৈতিক স্থিরতা, অর্থনৈতিক স্থিতি এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা।
তবু রাজনীতির পথ কখনোই মসৃণ ছিল না তাঁর জন্য। প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিপক্ষের কঠিন চ্যালেঞ্জ, বিরূপ পরিস্থিতির অনবরত চাপ তাঁকে প্রতিনিয়ত নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে। ক্ষমতার আসনে থাকলেও তিনি জানতেন সংলাপ আর সমঝোতাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলভিত্তি। তাই নানা উত্তাপের মধ্যেও তিনি বারবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কথোপকথনের আমন্ত্রণে, বিরোধীদের সঙ্গে সহাবস্থানের পথ খুঁজেছেন রাষ্ট্রের স্বার্থে। বিরোধীর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক সহাবস্থান বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, একটি রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী, যখন বিরোধী দলকে শত্রু নয়, বরং গণতন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় রাজনীতি নয় বরং ব্যক্তিগত জীবন। স্বামীকে হারানোর পর তাঁকে আরও বহুবার কঠিন শোকের মুখোমুখি হতে হয়। ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু তার মধ্যে অন্যতম। একজন মায়ের জন্য সন্তানের মৃত্যু এমন এক ব্যথা, যা কোনো ভাষা ধারণ করতে পারে না। সেই শোক, সেই নিঃসঙ্গতা এবং গভীর আবেগ তাঁর জীবনে প্রচণ্ড ক্ষত তৈরি করেছিল। তবুও তিনি দলের দায়িত্ব সামলে রেখেছেন, জনগণের জন্য রাজনীতি ধরে রেখেছেন। তিনি ভেঙে পড়তে পারতেন, কিন্তু ভাঙেননি এটাই তাঁকে অনেকের কাছে কিংবদন্তী করে তোলে।
এরপর আসে রাজনৈতিক নির্যাতনের কঠোর বাস্তবতা। মামলায় জড়িয়ে পড়া, গ্রেফতার, কারাবরণ, চিকিৎসা সংকট। বহু বছর ধরে তিনি বন্দিজীবন কাটান, যন্ত্রণা সহ্য করেন। তাঁর চলাফেরার স্বাধীনতা সীমিত থাকে, যোগাযোগের সুযোগ সংকুচিত হয়। শারীরিক অবস্থা দ্রুতই অবনতির দিকে যায়। তবুও মানসিক দৃঢ়তায় তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। মানুষ দেখেছে তিনি কিভাবে একা, নিঃসঙ্গতা সত্ত্বেও নিজের বিশ্বাস ধরে রেখেছেন। রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রশ্নে তাঁর আপোষহীনতা ছিল সুস্পষ্ট। সীমান্ত, জলবণ্টন, বাণিজ্য বৈষম্য, নিরাপত্তা- এসব বিষয়ে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। কোনো প্রভাবশালী বা আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে মাথানত না করার যে শক্ত মনোভাব তিনি দেখিয়েছেন, তা তাঁকে জনগণের কাছে শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর নেতৃত্বের মূলমন্ত্রই ছিল, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়।
আজ তিনি অসুস্থ। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, কারাগারের কষ্ট, বারবার চিকিৎসায় বাধা সব মিলিয়ে তিনি হয়ত জীবন সায়াহ্নে এসে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর স্মৃতি, তাঁর সংগ্রাম এবং তাঁর দীর্ঘ সময়ের নেতৃত্ব সবই তাকে অমর করে রেখেছে মানুষের মনে। তিনি এখন অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছেন, আর সারা দেশের লাখো মানুষ তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর নাম তাই এক অমোচনীয় চিহ্ন, যে চিহ্ন সময়কে ছাপিয়ে টিকে থাকবে। তাঁর জীবন এক সংগ্রামী নারীর গল্প, এক দৃঢ় নেত্রীর ইতিহাস, এক মানবিক মায়ের বেদনা ও এক রাজনৈতিক প্রতীকের শক্তি। আমরা তার সুস্থতা কামনা করি, যেন তিনি আবার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসতে পারেন, যেন দেশের মানুষ তাঁকে আবারও দেখতে পারে সুস্থ, শান্ত এবং নিরুদ্বেগ অবস্থায়, যেন তাঁর বাকি জীবন থাকে শান্তির, প্রার্থনার, আর মানুষের ভালোবাসার আলোয়।
লেখক
সুলতান মাহমুদ সরকার
কলামিস্ট, এমফিল গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক
গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/148636