গার্মেন্টস খাতের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

গার্মেন্টস খাতের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মূলত কয়েকটি বিষয়ের ওপর। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রযুক্তি ও অটোমেশনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন বাজার অনুসন্ধান ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা প্রসার, ডলার সংকট নিরসন ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা এবং স্থানীয় ব্র্যান্ড গড়ে তোলা। যদি এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যায়, তবে পোশাক শিল্প কেবল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার জোগানদার হিসেবেই থাকবে না, বরং একটি টেকসই ও মর্যাদাবান শিল্প হিসেবে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত হবে। পোশাক শিল্প একদিকে সংকটে জর্জরিত হলেও অন্যদিকে সম্ভাবনায় ভরপুর। এই শিল্পকে ঘিরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে। 

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প যেন এক বিশাল জাহাজ যে জাহাজ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, তৈরি করছে রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক পরিবর্তনের পথ। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্যে থাকা খাতটি এখন এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যেখানে আগের মতো সরল পথ আর নেই, বরং সামনে রয়েছে বহু কঠিন চ্যালেঞ্জ। 

প্রথমত, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র। ভিয়েতনাম, চীন, ভারতসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তি, অটোমেশন ও উচ্চমানের উৎপাদনের মাধ্যমে কম সময়ে উন্নতমানের পোশাক তৈরি করছে। ফলে বাংলাদেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রক্রিয়া দিয়ে টিকে থাকা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরের পরিবর্তনও গার্মেন্টস খাতকে চাপের মুখে ফেলেছে। শ্রমিক মজুরি ও সুবিধা বাড়ানো মানবিক দিক থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও, এতে কারখানার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেতারা অধিক দাম দিতে অনাগ্রহী হওয়ায় অনেক কারখানাই কম লাভে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তৃতীয়ত, টেকসই উৎপাদনের বৈশ্বিক চাপ দ্রুত বাড়ছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তোলা, পানি ব্যবহার কমানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, কার্বন নিঃসরণ কমানো এসব মান বজায় রাখতে প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো সামাল দিতে পারে, কিন্তু ছোট ও মাঝারি কারখানার জন্য এটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তিগত রূপান্তরও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। রোবোটিক্স, ৩ডি ডিজাইন, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ সবকিছুর ব্যবহার বিশ্বব্যাপী দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু এসব পরিচালনার জন্য যে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে এখনো পর্যাপ্ত নয়। 

অন্যদিকে কাঁচামালের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও গার্মেন্টস শিল্পকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সুতা, ফেব্রিক, কটন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেমিক্যাল বেশিরভাগ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক শিপিং সংকট, রুট পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো সমস্যা, যা ডেলিভারি সময়কে অনিশ্চিত করে তুলছে। শ্রমিক-নিরাপত্তা, শ্রম আইন, বেতন কাঠামো এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক নজরদারিও এখন অনেক বেশি। কোনো অস্থিরতা দেখা দিলেই অর্ডার বাতিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এর পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে।

 সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত সামনে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই এই বৃহৎ খাতকে টিকিয়ে রাখতে পারে। প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, দক্ষ কর্মী তৈরির উদ্যোগ, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং বাজার বৈচিত্র্য এসব ক্ষেত্রে এখনই গুরুত্ব দিতে না পারলে ভবিষ্যতের বড় ঢেউ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। 

লেখক

মিতু আক্তার তানজিলা

শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/148530