তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেন দীর্ঘশ্বাস না হয়
জাতীয় নির্বাচনের আমেজে যখন মেতে উঠছে দেশবাসী, তখন তিস্তাপাড়ের মানুষের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট প্রাণের আকুতি নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার । ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিস্তাপাড়ের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নতুন আশায় বুক বেঁধেছে। তিস্তা বাংলাদেশের উত্তর জনপদের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন যাপন সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত একটি নদীর নাম। তিস্তা নদীকে বলা হয় উওর জনপদের প্রাণ। ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন এ নদী পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ অংশে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন দিয়ে প্রবেশ করেছে, এটি লালমনিরহাট রংপুর ও গাইবান্ধার মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। শত শত বছর ধরে বহমান তিস্তা নদী উত্তর জনপদের মানুষের জীবন জীবিকা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ১১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হলেও এর মধ্যে বেশিরভাগই অংশ ভাঙনপ্রবণ ও ভয়াবহ বন্যার শিকার। ১৯৯৮ সালে তিস্তার ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারত একতরফাভাবে গজলডোবা ব্যারাজের নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ফলে ভরা বর্ষা মৌসুমে ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে প্লাবিত হয় বাংলাদেশের পাঁচটি জেলার অন্তত দুকোটি মানুষ। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এ নদীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংকটে তিস্তা পরিণত হয় বিরানশূন্য মরুভূমির মতো শুকনো চরে। তিস্তার পানিতে কখনো বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি, মাঠ-ঘাট ডুবিয়ে দেওয়া ম্যান মেইড বন্যা আর কখনো পানির অভাবে তিস্তার মাটি ফেটে যাওয়া খরা। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এ জনপদে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শুধু কৃষিই নয়, নদীর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বন্ধ হয়ে গেছে নদী পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিলীন হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম। এর ফলে তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সৎকটে পড়েছে। বর্ষাকালে বার বার বন্যার ফলে নদী ভাঙন আর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় । এই দুই মিলে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবন যুদ্ধে স্বাভাবিক জীবন যাপন হয়ে ওঠেছে দুর্বিষহ।
দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবিরোধের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টনের ফলপ্রসূ কোনো সুরাহা হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ১৯৮৩ সালে চুক্তি হলেও তা নির্দিষ্টভাবে কার্যকর হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে ২০১১ সালের তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। এর পর ভারত থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বন্যা, খরা, নদী ভাঙনের মত সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভারতের পানি প্রত্যাহারের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতে, ২০১৬ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের অধীনে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মডেলে তিস্তার দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে, নদী খনন, চর খনন করা হবে। বন্যার পানি গ্রামাঞ্চলে প্লাবিত করবে না, সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণ করা যাবে। এছাড়া তীর রক্ষা নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, কৃষিজমি উদ্ধার ও ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণ বৃদ্ধি পাবে। নদীর দুই তীরের জনপদের জন্য নির্মিত হবে ১৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ-বন্দর, থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনী ক্যাম্প। তিস্তাপাড়ের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শিল্প -কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, বনায়ন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সরকার ২০২১ সালে তিস্তা মহাপরিকল্পনা তৈরি করে, কিন্তু চার বছর কেটে গেলেও কাজ শুরু হয়নি। বাংলাদেশের ভূখন্ডে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের সহায়তায় কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক ভারত তা কখনোই চায়নি। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পানি আটকে রেখে ভারত যেমন তিস্তার শ্বাসরোধ করেছে। তেমনি বরাবর তিস্তা জাতীয় রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে। এছাড়া তিস্তা বাংলাদেশ,ভারত, চীনের ভৌগোলিক রাজনীতির বড় কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ভারত ও চীনের কুটনৈতিক বেড়াজালের মধ্যে কাগজে-কলমে আটকে ছিল প্রকল্পটি। ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের পর থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিস্তাপাড়ের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠ থেকে এবার উঠে এসেছে, জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই আহ্বান। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, জুলাই সনদ স্বাক্ষর ,পতিত আওয়ামী লীগের বিচার, জাতীয় নির্বাচন নানা আলোচনার মধ্যেও বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন । তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে তিস্তাপাড়ের কৃষক, জেলে, ছাত্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী সর্বস্তরে মানুষের অংশগ্রহণে তিস্তা পাড়ে সমাবেত হয়ে ভারতের নিয়ন্ত্রিত জল প্রবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সবার মুখে একটাই কথা ন্যায্য পানির হিস্যা চাই, নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ। তিস্তা পাড়ের মানুষ পরিবর্তিত সময়ে প্রধান উপদেষ্টার নিকট স্মারকলিপি পাঠানো, তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে নদীর অববাহিকায় ১০৫ কিলোমিটার মশাল মিছিল ও সমাবেশসহ বিভিন্ন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তাপাড়ের এক গণশুনানিতে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা কাজ শুরুর আশ্বাস দেন। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজস্ব অর্থায়ন, ভারত-বিষয়ক জটিলতা এবং নদীর অববাহিকায় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও চীনের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ভারতের অনিচ্ছা, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় আসন্ন এয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরেই প্রকল্পের কাজ শুরুর আহ্বান জানিয়ে আসছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিস্তার কাজ শুরুর কোনো নমুনা এখনও দৃশ্যমান হয়নি। ফলে তিস্তাপাড়ের মানুষের এখন একটাই দাবি ২০২৬ এর জানুয়ারি নয় আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হোক । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে তিস্তাপাড়ের প্রান্তিক মানুষ। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস নয়, বরং দৃশ্যমান কাজ দেখার অপেক্ষায় এখন দিন গুনছেন তিস্তাপাড়ের লাখ লাখ মানুষ ।
লেখক
আল-আমিন ইসলাম
শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ্ এন্ড ল বিভাগ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।