প্রবীণদের প্রতি সদয় হোক সমাজ, রাষ্ট্র

প্রবীণদের প্রতি সদয় হোক সমাজ, রাষ্ট্র

শৈশবের সকাল শেষে যৌবনের উজ্জ্বল দুপুর পেরিয়ে যখন জীবনের পড়ন্ত বিকেলও ধূসর হয়ে ওঠে,তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় সায়াহ্ন বেলা। এটিই জীবনের বার্ধক্যকাল বা প্রবীণ সময়। দীর্ঘ জীবন পাওয়া প্রতিটি মানুষকেই এই অনিবার্য সময়ের মুখোমুখি হতে হয়। তখন তাকে ঘিরে ধরে বিষন্নতা, শারীরিক দুর্বলতা, বার্ধক্যের নানান রোগ-শোক। এ এক কঠিন সময় তাদের জন্য। যদি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ও প্রিয়জনদের  সাপোর্ট না থাকে,তাহলে তাদের সময়টি হয়ে পড়ে আরো দুঃসহ। বাস্তবে সেরকম কষ্টকর অবস্থা এখন হয়েছেও তাদের। বিশেষ করে এক সময়ের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর বার্ধক্যে উপনীত হওয়া প্রবীণদের বেশিরভাগই এখন নিদারুণ অবহেলার শিকার। অথচ এই প্রবীণরা আমাদেরই অতি আপনজন তথা দাদা, দাদী, নানা-নানী, পিতা-মাতা, চাচা-চাচি, মামা-মামি, যাঁরা এই আধুনিক সমাজেরই রূপকার, পরম শ্রদ্ধেয় গুরুজন।

জাতিসংঘের প্রবীণ বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ বলে অভিহিত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ জনশুমারী অনুযায়ী দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখেরও বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। এর আগের শুমারিতে এ হার ছিল ৭.৪৭ শতাংশ। ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪২ বছর। বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭২ বছর, অচিরেই যা ৮০ বছরে উপনীত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। মানুষের এই আয়ু বৃদ্ধি মানে জীবন অভিজ্ঞ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, যাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও পরামর্শ তরুণ প্রজন্মের সুস্থ জীবন ও সমাজ গঠনে অনেকাংশে সহায়ক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো-এ সমাজে প্রবীণদের কল্যাণে কার্যকর কোন ব্যবস্থা আজো গড়ে ওঠেনি। ফলে তাদের অনেকেই আজ অবহেলার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে নিঃসঙ্গ, অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কী চান আমাদের প্রবীণ সমাজ? বৃদ্ধ বয়সে সন্তান, নাতি নাতনিদের সঙ্গে থেকে জীবনের শেষ বেলাটুকু আনন্দ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া, প্রয়োজনীয় খাবার ও চিকিৎসার সাথে একটু যত্ন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। এটুকুই তো? খুব অসম্ভব কি এটুকু দেওয়া? আমরা লক্ষ্য করি-অনেক সন্তানের আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও কর্মব্যস্ততার কারণে তারা বাবা মায়ের যত্ন নিতে পারে না। অনেক বাবা মা আবার নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে ছেলের কর্মস্থলে যেতেও চান না। এর উল্টোদিকে অনেক সন্তান নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দিয়ে বাবা মার দেখভালের দায়িত্ব তো নিচ্ছেই না, উপরন্তু বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে বাবার পেনশনের টাকা বা বাড়িঘর পর্যন্ত জোর করে লিখে নিচ্ছে। ভাবা যায় কতটা অমানবিক আচরণ! সম্প্রতি এ ধরনের এক খবরে প্রকাশ- সন্তানের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত বগুড়ার শেরপুরের আশি বছর পার করা এক বৃদ্ধ হায়দার আলীর একমাত্র ছেলে তার দিকে ফিরেও তাকায় না। বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে পাঁপড় ভেজে বিক্রি করে কোনমতে পেটের রসদ যোগাড় করতে হচ্ছে। শরীরে না কুলোলে কোন কোনদিন সেই পাঁপড়ও বিক্রি করা সম্ভব হয় না তার। অন্য এক খবরে দেখা যায়-কাহালুর এক গ্রামের বিধবা  বৃদ্ধা রশিদা বেগম হানুর দুটি উপার্জনশীল ছেলে তাদের মাকে বোঝা মনে করে নির্দয়ভাবে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। ভিক্ষার থালা নিয়ে তাই সে ঘুরে ফিরছে এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি। দেশের আনাচে কানাচে এরকম কত যে হায়দার আলী, রশিদা বেগম হানু সন্তানদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে, ভিক্ষা বা কাজে অক্ষম হয়ে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, কে তার হিসেব রাখে? অথচ আমরা ভুলে যাই-অতীতে কর্মক্ষম বয়সে এই প্রবীণরাই তাদের জীবন যৌবন, অর্জিত সকল দক্ষতা, শ্রম উৎসর্গ করে এসেছেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যই। সেজন্যই  তারা শিশুর মতো যত্ন ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন।

তাদের অবহেলা না করে মর্যাদার সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়ানো সমাজ ও রাষ্ট্রের  নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। তাদের জন্য প্রয়োজন নিয়মিত প্রবীণ ভাতা, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন প্রবীণবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য বিনামূল্যে আলাদা চিকিৎসা ইউনিট থাকা উচিত। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরিজীবীদের জন্য মাসিক যে ২৫০০ টাকার চিকিৎসা ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে, তা বর্তমান চিকিৎসা খরচের জন্য খুবই অপ্রতুল। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এই ভাতা কমপক্ষে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাস, ট্রেন ও আকাশপথে প্রবীণদের জন্য অর্ধেক ভাড়া ও সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি শহরে এমন প্রবীণবান্ধব আশ্রম গড়ে তোলা হোক, যেখানে থাকবে হাসপাতাল, মানসম্মত খাবার, খেলাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা,প্রার্থনার স্থান ও আরামদায়ক আবাসন। একসঙ্গে থাকার কারণে প্রবীণরা সেখানে নিরাপদ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সময় কাটাতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা নিজেদের খরচ বহন করবেন আর গরীব ও অসহায় প্রবীণদের জন্য থাকবে সরকারি অর্থ সহায়তা। তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে-আজ প্রবীণদের জন্য যা কিছু চাওয়া হচ্ছে, কাল সেটাই তাদের বার্ধ্যক্য জীবনের নিরাপত্তা হয়ে দাঁড়াবে। তাই প্রত্যাশা-প্রবীণদের জন্য সমাজ ও প্রশাসনের সকল স্তরে জাগ্রত হোক সহৃদয় কল্যাণবোধ। 

লেখক

রাহমান ওয়াহিদ

কবি, কথাশিল্পী ও কলামিষ্ট 

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/148020