শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছে খরস্রোতা তিস্তা, মুক্তির প্রত্যাশায় দুই কোটি মানুষ

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছে খরস্রোতা তিস্তা, মুক্তির প্রত্যাশায় দুই কোটি মানুষ

রুহুল ইসলাম রয়েল, গঙ্গাচড়া (রংপুর) : এক সময় উত্তরের নদী তিস্তাকে বলা হতো এ অঞ্চলের জীবনরেখা। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মালদহ সীমান্তে গজলডোবায় তিস্তা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের পরই ধীরে ধীরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে এ নদী।

উত্তরাঞ্চলের জীবন-জীবিকার প্রধান এই নদী আজ পানিশূন্য, মৃতপ্রায়। বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটারজুড়ে নদীর বুকে বালুচর, ভাঙন আর শুষ্কতা আজ তিস্তাপাড়ের দুই কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের হৃদয়ক্ষত।

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পানি আটকে একদিকে ভারত যেমন করেছে তিস্তার শ্বাসরোধ, অন্যদিকে গেল দেড়দশক ধরে তিস্তা হয়ে উঠেছে এ দেশের জাতীয় রাজনীতির বড় অনুষঙ্গ। তবে তিস্তা এখন কেবল জাতীয় রাজনীতির হাতিয়ারই নয়, হয়ে উঠেছে চীন-ভারত আর বাংলাদেশের ভৌগোলিক রাজনীতির বড় কেন্দ্রবিন্দু।

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন সরকারের উদ্যোগে আবারও জেগে উঠেছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। সম্প্রতি নীলফামারীতে চীনের সহায়তায় এক হাজার শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত স্থানীয়দের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদক্ষেপ বৃহত্তর তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকেই ইঙ্গিত বহন করছে।

১৯৮৩ সালে শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য ৩৬ শতাংশ ও ভারতের জন্য ৩৯ শতাংশ পানি বরাদ্দের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা কাগজেই রয়ে গেছে। পরে ২০১১ সালে সমান পানি বণ্টনের খসড়া প্রস্তুত হলেও রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিস্তাপাড়ের মানুষের ক্ষোভ স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

শুকনো মৌসুমে তিস্তার ন্যায্য পানি না পাওয়ায় নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। বোরো ধান, ভুট্টা, পাট, সবজিসহ বহু ফসল পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনে বিলীন হয় হাজারো পরিবার। তিস্তাপাড়ের মানুষের দাবি-এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ছাড়া উত্তরাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

রিজিওনাল জাস্টিস অ্যান্ড রাইটস-(রিজু), ফেলো অধ্যাপক ইলিয়াস প্রামাণিক বলেন, বাংলাদেশ যদি ন্যায্য পানির হিস্যা পায়, তাহলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও জনজীবনে আমূল পরিবর্তন আসবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, তিস্তায় যে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং কৃত্রিমভাবে পানি আটকে রাখার ফল। অভিন্ন নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য ভয়াবহভাবে নষ্ট হচ্ছে।

২০২১ সালে চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনার নকশা প্রস্তুত করে। ২০২৩ সালে মাঠপর্যায়ে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতের আপত্তি ও তৎকালীন সরকারের নীরবতার কারণে প্রকল্পটি থেমে যায়। তবে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবারও যাত্রা শুরুর আভাস মিলছে। নীলফামারীর দারোয়ানী টেক্সটাইল এলাকায় ২৫ একর জমিতে হাসপাতাল নির্মাণের চীনা উদ্যোগকে অনেকে ইতিবাচক সঙ্কেত হিসেবে দেখছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ত্বহা হুসাইন বলেন, চীন যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ পুনরায় শুরু করতে চায়, এ হাসপাতাল প্রকল্প তাদের সেই আগ্রহের প্রাথমিক ইঙ্গিত। শিক্ষক ও গবেষক উমর ফারুক মনে করেন, এ হাসপাতাল নির্মাণ ভারতের প্রতিক্রিয়া পরিমাপের পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ হতে পারে। চীন এ অঞ্চলে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারলে তিস্তা মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হতে পারে।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও আন্দোলন-এর সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, আমরা চাই ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শুরু হোক। এটি চীন বা ভারতের প্রকল্প নয়- এটি বাংলাদেশের প্রকল্প, বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যতের প্রকল্প। বিগত সরকার পরিবর্তনের পর নদীজুড়ে ১১৫ কিলোমিটার এলাকায় মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। তাদের একটাই দাবি দশকের পর দশক ধরে পানিশূন্য তিস্তা বাঁচাতে মহাপরিকল্পনার কাজ যেন দ্রুত শুরু হয়।

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147997