চরম অব্যবস্থাপনায় দৈনন্দিন নগরচিত্র 

চরম অব্যবস্থাপনায় দৈনন্দিন নগরচিত্র 

আমি নাগরিক আমার চেতনার ভেতর প্রতিদিন ভেসে ওঠে এই দেশের শহরজীবনের নানারঙা ছবি। কেউ দেখে উন্নয়ন কেউ দেখে অব্যবস্থাপনা কিন্তু আমি দেখি এক শহরের প্রাণচিত্র। যেখানে মানুষ বাঁচে, লড়ে, ক্লান্ত হয় তবুও আশায় বুক বাঁধে। আমার চেতনার যত ছবি ভাসে তার পনেরো আনা জুড়ে থাকে এই নগরচিত্র।

যেখানে রাজনীতি  অর্থনীতি  সমাজ ও মানবিকতা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে এক জটিল বাস্তবতা গড়ে তুলেছে। আজকের শহরগুলো ঝলমলে। ঢাকা  চট্টগ্রাম রাজশাহী সবখানেই উন্নয়নের চিহ্ন দৃশ্যমান। মেট্রোরেল ছুটে যায়।  নতুন সড়ক তৈরি হয় আলোকিত হয় ফুটপাত। কিন্তু এই উন্নয়নের নিচে গুমরে ওঠে ক্লান্ত মানুষের নিঃশ্বাস। যানজট,  ধুলা, শব্দদূষণ, অনিরাপদ ফুটপাত এসব মিলেই গড়ে উঠেছে নাগরিকের দৈনন্দিন সংগ্রাম। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটে। এটি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয় মানুষের মানসিক অবসাদেরও কারণ। সকালবেলা স্কুলে যাওয়া শিশু অফিসগামী কর্মী বা হাসপাতালের রোগী সবাই এই অনন্ত অপেক্ষার শহরে বন্দি। উন্নয়ন বাড়ছে তবে স্বস্তি কমছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। জিডিপি বাড়ছে অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান সাধারণ নাগরিকের রান্নাঘরে পৌঁছায় না। বাজারে গেলে বোঝা যায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমে গেছে। ডিম, চাল, তেল, ভাড়া সব কিছুর দাম বাড়ছে অথচ বেতন চাকরির নিরাপত্তা কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ সেই হারে বাড়েনি। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন টিকে আছে সমন্বয় শব্দের ওপর খরচ কমিয়ে চাহিদা গিলে স্বপ্ন বেচে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতি তখনই অর্থবহ যখন তা মানুষের জীবনে স্পর্শ আনে। সেই স্পর্শটাই আজ অনুপস্থিত। নগর রাজনীতি এখন প্রতিশ্রুতিতে ভরা বাস্তবে ফাঁকা। নির্বাচনের সময় স্মার্ট সিট, নিরাপদ সড়ক, স্বচ্ছ সেবা  এসব প্রতিশ্রুতি মাইকফোনে বাজে কিন্তু ভোটের পর সেগুলো হারিয়ে যায় জলাবদ্ধ রাস্তায়। নগর সেবার দুরবস্থা আজ নাগরিক জীবনের অন্যতম বড় যন্ত্রণা। পানি, গ্যাসের অভাব, মশার উপদ্রব, আবর্জনার স্তুপ সবই যেন নগরবাসীর ভাগ্যে লেখা এক অনন্ত পরীক্ষা। আমি চাই নগর প্রশাসন হোক জবাবদিহিমূলক। নির্বাচিত প্রতিনিধি হোক জনগণের প্রকৃত কণ্ঠস্বর। ক্রমশ মানুষ বাড়ছে কিন্তু  মানবিকতা হারাচ্ছে। এই শহরে এখন সব আছে অফিস  ফ্ল্যাট  ইন্টারনেট কিন্তু নেই আন্তরিকতা। প্রতিবেশী, অপরিচিত বন্ধুরা, ব্যস্ত আত্মীয়দের দেখা মেলে অনলাইনে। তরুণ প্রজন্ম হতাশায় ভুগছে কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। আত্মহত্যা ও মানসিক বিষন্নতার হার বাড়ছে নীরবে। শহরে মানুষ হাজার কিন্তু একাকিত্ব আরও গভীর। মানবিকতার এই অভাবই আজকের সমাজের সবচেয়ে বড় সংকট। আমরা উন্নত হচ্ছি কিন্তু মানুষকে  ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি। ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি। নদী মরে গেছে,  গাছ কাটা পড়ে  খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা সব নদীই দখল আর বর্জ্যে নীরব মৃত্যু বরণ করছে। উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতি হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি।

একটি শহর তখনই টিকে থাকে যখন সে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করে। আমরা সেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। এমন সময় মানবিকতার পুনর্জাগরণই আগামী বাংলাদেশের চাবিকাঠি। আমাদের শহর আজ শুধু ইট পাথরের সমাহার নয় এটি আমাদের চেতনা স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। উন্নয়ন চাই কিন্তু তার সঙ্গে চাই মানবিকতার উষ্ণতা। রাজনীতি হোক সেবার, অর্থনীতি হোক ন্যায়ের, সমাজ হোক সহমর্মিতার। নগর যেন শুধু বসবাসের জায়গা না হয়ে ওঠে হোক একে অপরের আশ্রয়। আমি নাগরিক, আমার চেতনার যত ছবি ভাসে তার পনেরো আনা এই নগরচিত্রই আমার সময়ের প্রতিচ্ছবি। এই শহর এখনো বেঁচে আছে কিন্তু হাঁপাচ্ছে। তবুও আশার জায়গা আছে। যখন মানুষ আবার মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে তখনই এই শহর সত্যিকারের মানবিক নগর হয়ে উঠবে। একটি হতাশ নগরচিত্ত তবুও আশাবাদী নাগরিক আমি। 

লেখক

ইতি আক্তার

শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147779