হারিয়ে যাচ্ছে বিল-ঝিলের শাপলা-শালুক!

হারিয়ে যাচ্ছে বিল-ঝিলের শাপলা-শালুক!

শাপলা এ দেশের পরিচিত জলজ উদ্ভিদ এর শিকড় পানির নিচে মাটিতে প্রোথিত থাকে, প্রতিটি পাতা একটি দন্ডের উপর পানিতে ভাসমান থাকে। এর যে অংশটি মাটির নিচে থাকে তাকে শালুক বলে, অনেক এলাকায় শাপলাকে শালুক ও বলে আবার অনেকে শাপলা গাছকে ও শালুক বলে। মাটির নিচে থাকা শালুক কাঁচা ও সিদ্ধ অবস্থায় খাওয়া যায়। পাতা ধরে রাখার দন্ডটিকেও খাওয়া যায়। দুরন্ত কিশোর কিশোরীরা দিনভর শাপলার ডাটা সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বাড়িতে সবজির যোগান দিতে। ছোট চিংড়ি মাছ দিয়ে শাপলা ডাঁটার সবজি খুবই মজাদার। শাপলা ফুলের বীজ থেকে তৈরি করা খাবারকে বলা হয় ভেটের খৈ। ওই ভেটের খৈ একটি মুখরোচক খাবার, কুটুম বাড়িতে যেতে, অতিথি আপ্যায়নে এর জুরি মেলা ভার। সরিষা বাটা দিয়ে শাপলা ভাজি, ডাল ও মাছের সাথেও খাওয়া যায়। তবে বেলে মাছ, ইলিশ মাছ ও চিংড়ি মাছের সাথে শাপলা তরকারি রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয়। কবির ছন্দে বলা যায়। হে শহুরে ভাই, তুমি কি যাবে আমার ছোট গাঁয়ে, হেথায় দিন কাটাব, শাপলা-শালুকের গান গেয়ে। ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাস এলেই দেখা যেত বিলে উৎসবের আমেজ। কৃষক ও দামাল ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার ফাঁকে দলে দলে যেত শালুক তুলতে। হাসি-আড্ডায় মুখর হতো চারদিক। তখন শালুক, শাপলা, বেট, উঠা- এসব ছিল সবার খাবার। 

লাল রঙের শাপলার চাঁই দেখতে লাল কর্পোরেট মতো মন হয়। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, সাদা শাপলা বাংলাদেশের জনগণের শুভ্রতা ও সরলতার প্রতীক। এটি বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হওয়ায় এর সৌন্দর্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। শাপলা কেবল সৌন্দর্যই ছড়ায় না, এটি গ্রামীণ জীবনে জীবিকার উৎসও বটে। অনেক মানুষ শাপলার ডাটা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এটি সাধারণত বর্ষা ও শরৎকালে বেশি জন্মায়। শাপলা এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যার সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং জীবনযাত্রার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের নদী-নালা, বিল-হাওরের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে এটি দেশের একটি প্রতীকী ফুল হিসেবে বিবেচিত।বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, কৃষক ও সাধারণ মানুষের জীবনের অংশ হিসেবে এই ফুলের উপস্থিতি দৃশ্যমান। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, কবিতা, গান এবং চিত্রকলা শাপলা ফুলের উল্লেখে ভরপুর।

শাপলার বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea nouchali. এই প্রজাতির শাপলার বৈশিষ্ট্য হলো সাদা ফুল, গোলাকৃতি ঘন সবুজ রংয়ের পাতা, পাতার কিনারা দাঁতের মত, সকাল ৮ থেকে ৯ টার মধ্যে এদের ফুল ফোটে আর বন্ধ হয় বিকাল ৩ থেকে ৪ টার মধ্যে। এই প্রজাতীর অধীনে আরো ২ রকমের শাপলা বাংলাদেশে পাওয়া যায় যার একটার ফুলের রং হালকা গোলাপী এবং অন্যটা হালকা নীল। এদের ফুলও সকাল ৮ টার দিকে ফুটে আর বন্ধ হয় বিকাল ৪ টার দিকে। Nymphaea nouchali ছাড়াও বাংলাদেশে যেসব প্রজাতীর শাপলা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে Nymphaea pubescen  এদের ফুলের রং সাদা, গোলাকৃতি হালকা সবুজ পাতা, পাতার কিনারা দাঁতের মত, রাতে এদের ফুল ফোটে, সকাল বেলা বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া আরো রয়েছে Nymphaea alba এদের ফুলের রং সাদা অথবা গোলাপী হয়, গোলাকৃতি হালকা সবুজ পাতা, পাতার কিনারা দাঁতের মত, রাতে ফুল ফোটে, সকাল বেলা বন্ধ হয়। Nymphaea rubra  নামে আরো এক প্রকার শাপলা আমাদের দেশে পাওয়া যায়। এদের ফুলের রং লাল, গোলাকৃতি লালচে সবুজ পাতা, পাতার কিনারা দাঁতের মত, রাতে ফুল ফোটে, সকাল বেলা বন্ধ হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও শাপলা শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল। তবে শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল শাপলার রং ঘন নীল। শাপলা পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি পাওয়া যায় তবে শাপলা ফুলের উৎপত্তিস্থল ভারত উপমহাদেশে, তবে এটি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই জলজ উদ্ভিদটি সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে পাওয়া যায এছাড়া শাপলার উৎপত্তি মিশরে হয়েছে বলেও অনুমান করা হয়, সেখান থেকেই সারা প্রিথিবীতে শাপলার প্রসার লাভ করেছে। মিশরের নীল নদে নানা রংয়ের শাপলা পাওয়া যায়। 

কারণ Autopolyploid ক্রমোজোম সংখ্যাযুক্ত গাছ বীজের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। কিন্তু এলোপলিপ্লইড গাছ তা পারে। এই বিবর্তন প্রকৃয়ায় সমভবতঃ নানা বৈশিষ্ট্যের শাপলার  জিনের মিশ্রনের ফলে আমাদের দেশের বর্তমান শাপলার জন্ম হয়েছে। সেটা ঠিক কি ভাবে ঘটেছে তা হয়তো এখনও জানা যায়নি তবে, যদি শাপলার জীবন রহস্য উন্মোচন হয় তবে হয়তো একদিন সেটা জানা যাবে, যেমন জানা গিয়েছে পাটের ক্ষেত্রে।  শাপলার ইংরেজী নাম যদিও ওয়াটার লিলি কিন্তু লিলিয়াম গোত্রের গাছের সঙ্গে শাপলার সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। কারণ শাপলা একটি প্রাথমিক পর্য্যায়ের  উদ্ভিদ যার ফুলের গঠন এবং গাছের আভ্যন্তরীন বৈশিষ্ট্য খুব সরল প্রকৃতির। কিন্তু বিবর্তনের মাপকাঠির বিচারে লিলিয়াম অনেক জটিল প্রকৃতির উদ্ভিদ। তাই লিলিয়াম আর ওয়াটার লিলি নামের দিক দিয়ে কাছাকাছি হলেও তাদের বিবর্তনগত দুরত্ব অনেক বিশাল। শাপলাতে থাকা ফ্লেভনল গস্নাইকোসাইড মাথায় রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে মাথা ঠান্ডা রাখে। শাপলা ফুল ইনসুলিনের স্তর স্থিতিশীল রেখে রক্তে শর্করা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। শাপলা শরীরকে শীতল রাখে, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায় ও পিপাসা দূর করে। সাধারণ অনেক শাকসবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় আলুর চেয়ে সাত গুণ বেশি ক্যালশিয়াম রয়েছে। চর্মরোগ ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। লাল শাপলা অ্যালার্জি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এই জলজ উদ্ভিদের অনেক গুণ রয়েছে, এটি ক্যানসার প্রতিরোধে উপকারি ভূমিকা রাখে। শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ‘বর্তমানে কৃষকরা অত্যাধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় জলাভূমির জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অন্য উদ্ভিদের মতো জলজ উদ্ভিদ শাপলার উৎপাদনও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে ও পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি এগিয়ে আসে, তাহলেই মঙ্গল। (সংগৃহীত তথ্য)

লেখক

ডি. কৃষিবিদ মো: ফরিদুর রহমান

সাধারণ সম্পাদক, ডিকেআইবি, বগুড়া জেলা শাখা

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147772