আবার ভূমিকম্প আতঙ্ক
স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা অফিস : দেশে দুই দিনের মধ্যে চতুর্থবারের মতো ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। গতকাল শুক্রবার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে ওঠে। এতে সারা দেশে অন্তত ১১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫.৭। উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী।
এবার আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে আবারও ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৩। উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ উপজেলা। এরপর আজ শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এরমধ্যে এক মিনিটের ব্যবধানে রাজধানীতে হয়েছে পরপর দুইবার। সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের দিকে প্রথম কম্পন অনুভূত হয়।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, এবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩ এবং উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে। আরেকটির উৎপত্তিস্থল ছিল বাড্ডায়, যার মাত্রা ৩ দশমিক ৭। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, আজ শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যায় দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩।
এদিকে শুক্রবার ৫ দশমকি ৭ মাত্রা ও আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) একই দিনে রাজধানীতে পরপর দুইবারসহ মোট চার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে আগামীকাল রোববার সকল ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা শঙ্কায় বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে তিন ছাত্রী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। হঠাৎ কম্পনে আতঙ্ক তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে। সিঁড়ি ও বারান্দা দিয়ে দৌড়ে নামতে গিয়ে ছয় শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার কিছু পরে এ ঘটনা ঘটে।
আহতদের মধ্যে শামসুন নাহার হলের তিনজন, কুয়েত মৈত্রী হলের একজন, বেগম রোকেয়া হলের একজন এবং মাস্টারদা সূর্য সেন হলের একজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে পাঁচজনই ছাত্রী। এ সময় সিঁড়ি ও বারান্দা দিয়ে দৌড়ে নামতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের তিন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
শামসুন নাহার হল সংসদের জিএস জানান, ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর হলের কয়েকটি ব্লকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। আতঙ্কে হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ইসরাত জাহান সুমনা সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় মারাত্মকভাবে পায়ে আঘাত পান। তার পা ভেঙে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি এবং আরও দুই আহত
শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে আবাসিক শিক্ষার্থী আনিকা তাসনিম সাংবাদিকদের জানান।
কুয়েত মৈত্রী হলের এক ছাত্রীও দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আহত হয়েছেন বলে আবাসিক শিক্ষার্থী শহিদা আক্তার প্রভা নিশ্চিত করেন। বেগম রোকেয়া হলে, আবাসিক শিক্ষার্থী সুমাইয়া আনজুম শারমিন জানান, আতঙ্কে একজন ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে সামান্য আঘাত পেয়েছেন। তাকেও ডিএমসিএইচ-এ নেওয়া হচ্ছিল। এদিকে, মাস্টারদা সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মামুনুর রশীদ হল খালি করার চেষ্টা করার সময় ধাক্কাধাক্কিতে আহত হন।
দুইদিনে চারবার ভূমিকম্প হওয়ায় দেশবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বললেন বারবার এমনটা হওয়ায় এটি বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা (আবহাওয়াবিদ) ফারজানা সুলতানা জানান, একটি বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। আবার ছোট ছোট ভূমিকম্পের পরে বড় ভূমিকম্প হয়।
মাধবদীর ভূকম্পনটি মাঝারি ধরনের ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, ১৯১৮ সালের পর দেশের ভেতরে এটা সবচেয়ে বড় শক হলো। সে সময় শ্রীমঙ্গলে ওই ভূকম্পনটি ছিল ৭ দশমিক ৬ মাত্রা। সে সময় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তিনি বলেন, ১০০ বছর বা ১৫০ বছর পরপর বড় ভূমিকম্প হয়। সেটার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছি আমরা। যেহেতু শত বছর আগে ডাউকি ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে।
এগুলোর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬ থেকে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার। ৮ দশমিক ১ মাত্রার হয়েছে ১৮৯৭ সালে, যার উৎপত্তি ছিল ভারতে। এরপর ১৯৫০ সালের ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিও ভারতের আসামে। এছাড়া মিয়ানমার, ভুটার, নেপালের ভূকম্পনের ঢেউও এসে পড়ে বাংলাদেশে।
এদিকে সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নিয়ে দেখা দিয়েছিল বিতর্ক। সকালে আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা জানিয়েছেন ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বাইপালে ৩ দশমিক ৩ মাত্রা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তিনি বলেন, সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে এই কম্পন রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র। পরবর্তীতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে আজকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর পলাশে।
আগের দিনের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছিল সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে; আর আজ শনিবার (২২ নভেম্বর)ের ভূমিকম্প অনুভূত হয় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে। যদিও কালকের ভূমিকম্পটি শক্তিতে ছিল অনেকটা দুর্বল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। তাই বড় ধরনের কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে উৎপত্তিস্থল নিয়ে সকাল থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, আজকের কম্পনের উৎপত্তিস্থল আসলে নরসিংদীর পলাশ। ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার (একই) হলেও অবস্থানগত দিক থেকে এটি আগের দিনের ভূমিকম্পের উৎস নরসিংদীর মাধবদীর কাছাকাছি।
এদিকে শুক্রবারের ভূমিকম্পে ১১ জন নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট সাড়ে চার শতাধিক মানুষের বেশি আহত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৬৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে এবং গুরুতর আহত ১৬ জনকে অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। তবে এর বাইরেও বহু রোগী দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং কোথাও কোথাও ভর্তি রয়েছেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই তথ্য এখনো হালনাগাদকৃত তথ্যে যুক্ত হয়নি। ফলে মোট আহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বংশালের কসাইটুলী এলাকায় একটি পাঁচ তলা ভবনের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে তিন পথচারী নিহত হন। নিহতদের মধ্যে দুজন বাবা-ছেলে বলে জানা গেছে। তারা হলেন হাজি আব্দুল রহিম (৪৭) এবং মেহরাব হোসেন রিমন (১৩)। এছাড়া মায়ের সঙ্গে বাজার করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফি।
তার মা নুসরাত গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া রাজধানীর মুগদার মদিনা বাগে ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে পড়ে মাকসুদ (৫০) নামের এক নিরাপত্তাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া নরসিংদীতে ৫ ও নারায়ণগঞ্জে ২ জন মারা গেছেন।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147516