ভূমিকম্পে নিহতের দাফন নিজ গ্রামে
স্টাফ রিপোর্টার এবং লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : ভূমিকম্পে নিহতরে দাফন তাদের নিজ গ্রামে সম্পন্ন হয়েছে। ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালের কসাইটুলীতে মায়ের সাথে মাংস কিনতে এসে ছাদের রেলিং ভেঙে পড়ে নিহত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম রাফির দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) বাদ যোহর বগুড়া শহরের সূত্রাপুরস্থ ঈদগাহে নামাজে জানাজা শেষে বিকেলে নামাজগড় গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) তার মরদেহ বগুড়ায় পৌঁছে। রাফির মরদেহ তার সূত্রপুরস্থ বাড়িতে নেয়া হলে মানুষের ঢল নামে। তারা একনজর দেখার জন্য বাড়িতে আসেন। পরে ঈদগাহে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বগুড়া শহর জামায়াতের আমির আবিদুর রহমান সোহেল, ৮নং ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর এরশাদুল বারী এরশাদসহ বহু মুসল্লি অংশ নেন।
এদিকে এই ঘটনায় গুরুতর আহত রাফির মাকে বগুড়ায় এনে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত রাফির মা নুসরাজ জাহানকে বিকেলে দাফনের আগে সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়। সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর অসুস্থ মা বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে রেখেই রাফির মরদেহ দাফনের জন্য গোরস্থানে নেওয়া হয়।
বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল ওয়াজেদ দাফন কাজে অংশ নেন। তিনি নিহত রাফির বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে সান্ত্বনা দেন এবং জানান, জেলা প্রশাসক বিষয়টির সার্বিক খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাফির মায়ের চিকিৎসার জন্য অনুদান প্রদান করেন। উল্লেখ্য, রাফিউল ইসলাম রাফি বাবা ওসমান গণি রুস্তম ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ বাঞ্চারাম সরকারি টেকনিকেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। রাফি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
লক্ষ্মীপুরে বাবা-ছেলের দাফন : রাজধানীর পুরান ঢাকায় ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ে নিহত আব্দুর রহিম (৪৮) ও তার ছেলে মেহেরাব হোসেন রিমনের (১২) দাফন লক্ষ্মীপুরে হয়েছে। আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের আস সুন্নাহ মাদ্রাসা ও মসজিদ কমপ্লেক্স মাঠে নিহতদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এর আগে ভোরে বাবা-ছেলের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন আত্মীয়-স্বজনরা। পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, আব্দুর রহিম রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি পুরান ঢাকার সুরিটোলা স্কুলের পেছনে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
গতকাল শুক্রবার সকালে মেজো ছেলে রিমনকে নিয়ে তিনি বাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। হঠাৎ ভূমিকম্পে একটি ভবনের ইটের রেলিং ভেঙে তাদের ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। বশিকপুর মহিলা মাদরাসার সুপার ও নিহতের নিকটাত্মীয় মাওলানা মোরশেদ আলম জানান, নিহত রিমন পুরান ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। আব্দুর রহিম ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের মৃত্যু খুবই কষ্টদায়ক।
পাকুন্দিয়ায় দাফন হলেন নরসিংদীতে দেওয়াল ধসে নিহত বাবা-ছেলে : নরসিংদীতে ভূমিকম্পে বাসার পাশের নির্মাণাধীন ভবনের দেওয়াল ধসে নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল (৩৮) ও তার নয় বছরের ছেলে ওমরের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার পাকুন্দিয়া পৌরসভার উত্তরপাড়া গ্রামের স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চাকরিজনিত কারণে দেলোয়ার নরসিংদী শহরের গাবতলী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। ভূমিকম্পের সময় পাশের বাসার একটি দেওয়াল ধসে তাদের ওপর পড়ে। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসকরা বাবা-ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল শুক্রবার সকালে দেলোয়ারসহ তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে গুরুতর আহত হন। প্রথমে নরসিংদী সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় তাদের। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হলে ছেলে ওমরকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেলোয়ার মারা যান। নিহত উজ্জ্বল বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনে উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন। ছেলে ওমর নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করতেন।
নিহতরা পাকুন্দিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। একই ঘটনায় নিহত দেলোয়ারের দুই মেয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের মৃত্যুতে এলাকায় শোক নেমে এসেছে। ‘কলিজার টুকরারে শেষ বিদায়ও দিতে পারলাম না’ : ‘কলিজার টুকরারে শেষ বিদায় দিতে পারলাম না। দাফন করার সময় তারে একবার দেখতেও পারলাম না, কোলেও নিতে পারলাম না, আল্লাহ! এমন দিন যেন কোনো বাবার ভাগ্যে না আসে।’- এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ভূমিকম্পে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দেয়াল ধসে নিহত ফাতেমার বাবা আব্দুল হক।
জানা যায়, আব্দুল হক চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন। দুই মেয়ে নিয়ে রূপগঞ্জের ইসলামবাগের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন কুলসুম। পাশের বাসায় ভাড়া থাকেন কুলসুমের মা-বাবা। সকালে তিনি ফাতেমাকে কোলে নিয়ে বাবার বাসায় যাচ্ছিলেন। এ সময় ভূমিকম্প টের পেয়ে রাস্তার ধারে একটি সীমানাপ্রাচীরের পাশে আশ্রয় নেন। প্রতিবেশী জেসমিনও সেখানে আশ্রয় নেন। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে মুহূর্তেই ধসে পড়ে সেই প্রাচীর। এতে চাপা পড়েন তারা। ঘটনা দেখে দৌড়ে সেখানে যান প্রতিবেশী ইমতিয়াজ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘ইট সরাইতে সরাইতে ফাতেমারে বাহির করলাম, কিন্তু বাঁচানো গেল না।’
এ ঘটনার পর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন আব্দুল হক। এ কারণে মেয়ের দাফনের সময়ও থাকতে পারেননি। বিকেলে বাড়ির পাশে ফাতেমার জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম বলেন, ধসে পড়া প্রাচীরটি অন্তত ১০ ফুট উঁচু ছিল। কিন্তু কোনো রডের কাজ সেখানে নেই। এমনকি উঁচু দেয়ালের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোনো পিলারও ছিল না। এ ধরনের অস্বাভাবিক রকম উঁচু দেয়াল বা অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয়া হবে। নিহতের পরিবারকে দাফনের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147512