তরুণ উদ্যমের আলোকবর্তিকা তারেক রহমান
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে চলেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী পাঁচ দশকে এই রাষ্ট্রে বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মূলত বয়সী, অভিজ্ঞ এবং প্রতিষ্ঠিত নেতারা। অথচ তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও আধুনিক নেতৃত্বের প্রতি প্রত্যাশা। এমন সময় যে নেতার নাম সবচেয়ে আলোচিত, তা হলো তারেক রহমান।
তিনি শুধু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন উত্তরসূরি নন তিনি এক নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধি, যাঁর ভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাষ্ট্রচিন্তা তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। রাজনীতির প্রতিকূলতার মধ্যে নেতৃত্ব শক্তিশালী হয় এ কথার জীবন্ত উদাহরণ তারেক রহমান। গ্রেপ্তার, নির্যাতন, মামলা, নির্বাসন সভ্য রাষ্ট্রের রাজনীতিতে যে প্রতিকূলতা সবচেয়ে কঠিন, তাঁর জীবনে সবই ঘটেছে। অথচ তিনি ভেঙে পড়েননি; বরং আরও দৃঢ়, অভিজ্ঞ ও পরিণত হয়ে উঠে এসেছেন। আজকের তরুণেরা তাঁর মধ্যে যে গুণটি সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে, তা হলো তিনি ভবিষ্যতের রাজনীতি বোঝেন এবং সেই ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করেন।
তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৭ সালে। তাঁর বাবা জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক। মা খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। এই পরিবারে বড় হওয়ায় তিনি দেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা, স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতা এই সবকিছুর সঙ্গে শিশুকাল থেকেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব কেবল উত্তরাধিকার থেকে তৈরি হয়নি। বরং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, গভীর বিশ্লেষণক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং রাষ্ট্র-সমাজকে নতুনভাবে বোঝার সক্ষমতা তাঁকে আলাদাভাবে প্রস্তুত করেছে। তরুণদের কাছে তাঁর পরিবার নয় তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ধরনই বেশি জনপ্রিয়। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন তারেক রহমান। তিনি দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নীতি প্রণয়ন এবং প্রজন্মান্তরের নেতৃত্ব তৈরির কাজে যুক্ত হন। বাংলাদেশে তখন তরুণদের অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক দলে তাদের সুযোগ কম, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা নেই এবং রাজনীতিতে আধুনিকতার ঘাটতি। তারেক রহমান এই তিনটিই পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তিনি দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় জেলায় গিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করেন যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খুব কম দেখা যায়। এই সফরগুলোর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন তৃণমূলই দলের আসল শক্তি; সংগঠনের শিকড় যদি শক্তিশালী করা যায়, তবে দলও শক্তিশালী হবে। এভাবে তিনি দলের কাঠামোয় নতুন প্রাণ আনেন। তাঁর এই সক্রিয় তৃণমূল যোগাযোগ তাঁকে তরুণদের কাছে পরিচিত করে একজন যধহফং-ড়হ ষবধফবৎ, যিনি মাঠের রাজনীতি বোঝেন এবং মানুষের সমস্যাকে গুরুত্ব দেন। ২০০১ -২০০৬ সময়কালে দলের রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে আলোচনায় আসে ‘হাওয়া ভবন’। এ নিয়ে বহু আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে।
কিন্তু একটি সত্য পরিষ্কার এ সময় দলীয় নীতি, নির্বাচনী কৌশল ও সংগঠন পরিচালনায় তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেসব কারণে তরুণরা এই সময় তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলো তিনি প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক আধুনিকতার ওপর জোর দেন, নতুন উদ্যোক্তা প্রজন্মকে উৎসাহিত করেন, তরুণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান, দলকে তরুণমুখী করার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি ছিল এক ব্যতিক্রমী ভূমিকা। কারণ তখনকার রাজনীতিতে আধুনিক চিন্তা, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং যুবসমাজের শক্তিকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রবণতা ছিল খুবই সীমিত। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি কঠোর নির্যাতনের শিকার হন। এই সময় তাঁর ওপর ভয়াবহ শারীরিক আঘাত, অসংখ্য মামলা, রাজনৈতিক চাপ এতটাই ছিল যে অনেকের মতে, এটি ছিল তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর কৌশল। কিন্তু এই ভয়াবহ সময় তাঁর মানসিক দৃঢ়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রমাণ করেন রাজনীতি শুধু ক্ষমতা নয়; রাজনীতি হলো সংগ্রাম এবং নীতিতে অটল থাকার শিক্ষা। অবশেষে চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি লন্ডনে চলে যেতে বাধ্য হন এবং এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রবাস পর্ব; যা পরবর্তী সময়ে তাঁর নেতৃত্বকে আরও পরিণত করে তুলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারণ নিয়ম হলো যে নেতা দেশে নেই, তিনি মাঠের রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। কিন্তু তারেক রহমান সেই প্রচলিত নিয়ম ভেঙেছেন। লন্ডন থেকে তিনি দলের নীতি নির্ধারণ, জাতীয় রাজনীতির কৌশল, প্রার্থী নির্বাচন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সভা–বক্তৃতা, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন এভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর ডিজিটাল নেতৃত্ব বিএনপিকে এমন এক আধুনিক কাঠামোর দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে অনলাইনে সংগঠন পরিচালনা, ভার্চুয়াল মিটিং, বার্তা প্রচার, তরুণদের সংযোগ সবই নতুন মাত্রা পেয়েছে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে তাঁর এই আধুনিক রাজনৈতিক দক্ষতায় মুগ্ধ।
কারণ তাঁরা এমন নেতা চান যিনি পৃথিবীর নতুন রাজনীতি বোঝেন এবং ডিজিটাল যুগের ভাষায় কথা বলেন। তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনে তিনটি বিষয় সবচেয়ে স্পষ্ট (১) একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র; তিনি বিশ্বাস করেন স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র টেকে না। (২) ভোটাধিকার ও নির্বাচন সংস্কার; তিনি মনে করেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের মূল হলো অবাধ নির্বাচন না থাকা। তাঁর বক্তব্য “ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।” (৩) তরুণ কেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল; তরুণদের দক্ষতা, আধুনিক প্রাযুক্তিক শিক্ষা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এসব বিষয়ের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই হবে তখনই, যখন তরুণরা অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নীতিনির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তারেক রহমানকে ঘিরে বিরোধীদের অপপ্রচারও কম নয়। মামলা, অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রচারণা সবই তাঁর জীবনের অংশ। কিন্তু এসবের মধ্যেও তরুণরা কেন তাঁকে অনুসরণের মতো মনে করে? কারণ একটাই তাঁর সংগ্রামের গল্প সত্য। তরুণেরা দেখেছে তিনি একের পর এক আঘাত পেয়েছেন, তাঁকে রাজনীতি থেকে সরাতে চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এই ধরণের স্থিতিশীলতা খুব কমই দেখা যায়। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন নেতৃত্ব মানে চাপের মুখেও পথ না হারানো। তিনি নতুন প্রজন্মের মতোই দক্ষতা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং স্বচ্ছ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। অনলাইন বক্তৃতা বা ভার্চুয়াল মিটিং সব ক্ষেত্রেই তিনি সহজ ভাষায় বিষয় বুঝিয়ে বলেন, যা তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তিনি তার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা স্পষ্ট করে বলেছেন তিনি একটি নতুন বাংলাদেশ চান, যেখানে স্বাধীন ভোট, ন্যায়বিচার, স্বচ্ছ শাসন এবং সবার অধিকার নিশ্চিত থাকবে। তরুণদের রাজনৈতিক প্রত্যাশার সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি মিলে যায়। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। আমাদের জানা যে, বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রের সংকট, অর্থনৈতিক চাপ, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, ভৌগোলিক বৈষম্য এসব বড় সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এখন প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নিবেন, দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রসংস্কার ভাববেন, বিবেচনায় রাখবেন তরুণদের ভবিষ্যৎ, এবং দলকে এগিয়ে নিতে পারবেন আধুনিক কৌশলে। এই সব মিলিয়ে অনেকেই মনে করেন তারেক রহমান বাংলাদেশের ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনাময় নেতা। তারেক রহমান আজ একজন ব্যক্তির নাম নয়; তিনি একটি প্রজন্মের স্বপ্ন, গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা এবং রাজনীতিতে আধুনিকতার প্রতীক। তাঁর জীবনে যেমন সংগ্রাম রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির দৃঢ়তা। তরুণরা তাঁর মধ্যে দেখে সাহস, মানসিক শক্তি, আধুনিক চিন্তা, তৃণমূল যোগাযোগ, রাষ্ট্রসংস্কারের দূরদর্শিতা। এ কারণেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয় “তারুণ্যের অনুকরণীয় নেতা” হিসেবে। একজন নেতা হিসেবে তাঁর যাত্রা এখনো চলছে, পথ কঠিন; কিন্তু তিনি অনুসরণীয় হয়ে উঠেছেন সেই কারণেই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি ধারণ করেন এবং সেই স্বপ্নই তাঁকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নেতৃত্বের অন্যতম প্রত্যাশিত মুখে পরিণত করেছে।
প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী
উপাচার্য
নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়।