সোনালি আঁশের পুনর্জাগরণে পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা

সোনালি আঁশের পুনর্জাগরণে পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা

পাটশিল্প একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসেবেই বিবেচিত হত। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর ‘সোনালি আঁশ’ নামে পরিচিত এই শিল্প দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় ৮০ শতাংশ অবদান রেখেছিল। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল ছিলো এই শিল্পের উপর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিন্থেটিক ফাইবার, পলিব্যাগের আগমন, সরকারের অব্যবস্থাপনা, নতুন উদ্যোগের অভাব এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।  বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে পাটশিল্প ছিলো মানুষের রোজগারের অন্যতম প্রধান উৎস। তবে এখন প্লাস্টিকের পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা বাড়ায় আবারো পাটশিল্পের চাহিদা কেবল দেশের মধ্যে নয়, বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। আন্তর্জাতিক জুট স্টাডি গ্রুপের তথ্যমতে, ২০২৯ সালের মধ্যে পাটপণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদন করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এর ৮০ শতাংশ রপ্তানিযোগ্য হলেও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আধুনিক নকশার অভাবে বড় বাজার হারানো হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা কাঁচা পাট কিনে নিজেদের দেশে প্রক্রিয়াজাত করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। যেখানে মোটা কার্পেট, থলে, পাটের কাগজ ও ফ্যাশনসামগ্রীসহ নানা পাটজাত পণ্য বিশ্ববাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়, সেখানে বাংলাদেশ এসব প্রক্রিয়াজাত পণ্যে মনোযোগ না দিয়ে মূলত কাঁচা পাট রপ্তানিতে বেশি জোর দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাত পাট পণ্যকে বেছে নিচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্য অনেক দেশ পাটশিল্পের প্রক্রিয়াকরণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশের সামনে পাটশিল্প নিয়ে বড় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশটি এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যের মান, নকশা ও প্যাকেজিং উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য মান নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে থাকার কারণে ক্রেতাদের আস্থা কমে। বিশ্বে অনেক বড় ব্র্যান্ড এখন ‘সাসটেইনেবল’ লেবেলের পণ্য ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা ব্যবহার করে ‘গ্রিন প্রোডাক্ট’ হিসেবে পাটপণ্য প্রচার করলে রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা পাট রপ্তানি কমিয়ে উচ্চমূল্যের ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্য উৎপাদনে নজর দিতে হবে। গবেষণা ও উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বিপণন, কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ জরুরি। নতুন ধরনের কাপড়, কম্পোজিট, বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসে উপস্থিতি বাড়ানোও অপরিহার্য। এছাড়া, পাটশিল্পের প্রক্রিয়াজাতকরণে বিভিন্ন কারখানা গড়ে তুললে দেশের বড় সমস্যা বেকারত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভবপর হবে। তবে পাটশিল্পের পূর্ণ উন্নয়নের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার অভাব, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের অভাব উল্লেখযোগ্য। পাটশিল্পে কালোবাজারির ফলে কৃষকরা তাদের নায্যমূল্য না পেয়ে পাট উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পাট উৎপাদনে তেমন কোনো খরচ না থাকলেও যথেষ্ট পরিশ্রম রয়েছে। এসবক্ষেত্রে সরকারের প্রয়োজন সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি, বাজারজাতকরণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উদ্ভাবনী পণ্য ও ডিজাইনে জোর দিতে হবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করাও জরুরি। 

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটশিল্প পুনরায় জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হতে পারে। যুগোপযোগী উন্নয়ন ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি দেশের কৃষি ও শিল্প খাতকে শক্তিশালী করবে, হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা রক্ষা করবে এবং পরিবেশবান্ধব বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করবে। তাই এখনই সরকারের উচিত পাট-শিল্পের উপর নজর দেওয়া। 

লেখক
মোছাঃ রোকেয়া সুলতানা
ইতিহাস বিভাগ
রাজশাহী কলেজ

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/147090