সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে চরের মানুষের যাপিত জীবন

সিরাজগঞ্জের  কাজিপুরে চরের মানুষের যাপিত জীবন

আবদুল জলিল, কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ): হেমন্ত গড়িয়ে শীতের আগমণী বার্তা প্রকৃতিতে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে এক সময়ের প্রমত্ত যমুনা এখন তার জৌলুশ হারিয়েছে। তার বুকে জেগে উঠেছে অনেক চর। আর সেই জেগে ওঠা পলিসমৃদ্ধ চরে এখন চলছে নতুন করে ফসল ফলানোর কর্মযজ্ঞ। কাজিপুরের যমুনা চরের সংগ্রামী মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই টিকে আছে বছরের পর বছর। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা চর ছাড়ে না।

বরং যমুনার তান্ডবকে জয় করে তার বুকে জেগে ওঠা চরে ধান, গম, সরিষা,  তিল তিশি, কাউন, মরিচ, ভুট্টা, বাদাম, সবজিসহ নানা শীতকালীন আবাদ করে। কোনটির আবাদ এরই মধ্যে শুরু করেছেন। নদীর টানেই কাজিপুরের যমুনার চরে অবস্থিত ছয়টি ইউনিয়নের পৌণে দুই লাখ মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙা জীর্ণ কাইশার (কাশ) ছাউনিওয়ালা ঘরে।

যে যমুনা তাদের বছরের পর বছর সর্বস্ব গ্রাস করেছে সে নদীই একদিন হয়তোবা ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমি-জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোতজমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে বর্ষা-বন্যা- ভাঙন-ঝড় বাদল মাথায় নিয়ে নদী আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে চরের মানুষ। শত দুঃখ যন্ত্রণা আর অভাব-অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে।

বর্ষাকালে যমুনা নদীর উত্তাল স্রোতোধারার সাথে উজান থেকে পানির সাথে নেমে আসে উর্বর পলি। শুস্ক মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলি চরবাসীর কাছে সোনার মতই দামী। যেন আশীর্বাদ। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ কাজিপুরের চরাঞ্চলের কৃষকদের ফুরসত নেই। দু’হাতে পরম মমতায় তারা চরের পলি সমৃদ্ধ মাটিতে বাদাম, ভুট্টা, মরিচ, সরিষাসহ নানা ধরনের সবজির বীজ বপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

জমিতেই তারা সকাল এবং দুপুরের খাবার খায়। চরের দিনমজুরেরা কাজের সন্ধানে ছুটে চলে এক চর থেকে  আরেক চরে। এরইমধ্যে জেগে ওঠা চরে লাগানো রোপা আমন কেটে জমিতেই মাড়াই করে ঘরে তুলছে কেউ কেউ। কেউবা চরের কাইশা কেটে চরেই শুকিয়ে আঁটি বেঁধে নৌকায় বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছে। চরবাসীর পরিবহনের জন্য পানিতে নৌকা আর মাটিতে ঘোড়ার গাড়ি, ভ্যানগাড়ি, আর কাঁধের ভারই একমাত্র ভরসা।

সকল কাজেই পুরুষের সাথে নারীরাও সমান তালে কাজ করে। কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি চরের নারী শ্রমিকদেরও কদর রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই যমুনায় চরের দেখা মেলে। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি চরের মাটিতেই নাটুয়ারপাড়া, চরগিরিশ, মনসুর নগর, নিশ্চিন্তপুর, তেকানি ও খাসরাজবাড়ী ইউনিয়নের মানুষের সংগ্রামী জীবনের নানামুখী ইনিংসের শুরু হয়।

তবে সব সময় চরের মানুষ জেগে ওঠা চরের জমির অধিকার পায় না। অনেক সময় প্রভাবশালীরা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে জেগে ওঠা চর দখলে নেয়। চরের মানুষ সে জমি বর্গা চাষ করে।  কাজিপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চরের মানুষ অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার জানান, ‘শুস্ক মৌসুমে চর থেকে আরেক চরে যাতায়াত খুবই কষ্টাসাধ্য ব্যাপার।

পায়ে হেঁটে, বাইসাইকেল অথবা কোন কোন চরে চলছে ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যানগাড়ি। তবে চরের মানুষের সংগ্রামী জীবন কোন কিছুতেই থেমে থাকে না। তাদের কঠিন হাতেই পুরো চরজুড়ে ফলে নানা ফসল। তাই চরকে কাজিপুরের শস্যভান্ডার বলা হয়।

নাটুয়ারপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের জানান, চরের প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে যমুনার ভাঙনের শিকার। আমাদের অনেকেই দশ থেকে বারোবার পর্যন্ত বাড়ি সরিয়েছে। তারপরও আমরা চরেই পড়ে আছি।

এতো প্রতিকূলতার পরও চরে যে ফসল ফলে তা অন্য কোথাও এতো সহজে ফলানো যায় না। এর ফলে চরের মানুষ চর ছাড়ে না। ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থাসহ সরকার তাদের জীবন মান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এমনটিই দাবি চরবাসীর।

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/146631