ভর্তি পরীক্ষার মেধা যাচাইয়ে ট্যাগের দৌরাত্ম্য!

ভর্তি পরীক্ষার মেধা যাচাইয়ে ট্যাগের দৌরাত্ম্য!

শিক্ষা এক সময় ছিল আলো ছড়ানোর হাতিয়ার। তখন বই ছিল চিন্তার জানালা, আর শিক্ষক ছিলেন আলোর দিশারী। কিন্তু এখন যেন সেই আলোর জায়গায় দাঁড়িয়েছে এক অন্ধ প্রতিযোগিতা। জ্ঞান নয়, সার্টিফিকেট এখন সফলতার মানদন্ড। পড়াশোনা মানে পরীক্ষার খাতা ভরাট, মুখস্থ করা, উত্তর গড়গড় করে বলে দেওয়া। শিক্ষা হয়ে গেছে এক ধরনের ব্যবসা, যেখানে ছাত্ররা পণ্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হচ্ছে ব্র্যান্ড। এখনকার শিক্ষার্থীরা জ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, বরং ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে প্রবেশ করাটাই যেন জীবনের শেষ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান শিক্ষা আজ প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। যেখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ট্যাগ’ই বলে দেয়, কে মেধাবী, কে নয়। 

বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই গ্রন্থগত বিদ্যা নির্ভর। শিক্ষার্থীরা শৈশব থেকেই বই মুখস্থ করার প্রতিযোগিতায় নামে। পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের মুখস্থ উত্তর লিখে ভালো নম্বর পাওয়াই যেন শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য। অথচ বাস্তব জীবনের সঙ্গে এসব জ্ঞানের সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভর্তি পরীক্ষা। এই পরীক্ষাগুলো এখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পথ নয়, বরং একটি মানসিক চাপ, এক অবিরাম প্রতিযোগিতা, যেখানে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এমন এক যুদ্ধে, যার জয়-পরাজয় নির্ধারণ করছে সমাজে তাদের অবস্থান। প্রতিবছর দেশে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ শিক্ষার্থী এই ভর্তি যুদ্ধে অংশ নেয়। দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এক অমানবিক প্রতিযোগিতা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা হয়তো ৬ হাজার, কিন্তু আবেদন পড়ে ৩ লাখ। মানে ২ লাখ ৯৪ হাজার শিক্ষার্থী অযোগ্য হয়ে যায় শুধুমাত্র একটি ট্যাগ না পাওয়ার কারণে। অথচ তাদের মেধা, শ্রম কিংবা সম্ভাবনা এর দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আরও ভয়ংকর বিষয় হলো অনেকেই মনে করে, যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারে, তবে জীবন শেষ। অনেক পরিবার এমন মানসিক চাপ সৃষ্টি করে যে শিক্ষার্থী নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে শুরু করে। এভাবেই জন্ম নেয় হতাশা, মানসিক অবসাদ, এমনকি আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক পরিণতি। 

ভর্তি পরীক্ষার এই অমানবিক প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে কিছু কারণ। যার মধ্যে অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক ট্যাগ নির্ভর সমাজ আমাদের সমাজে এখনো ‘কোথায় পড়েছো’ এই প্রশ্নটাই মুখ্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীকে মেধাবী বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যোগ্যতা, চিন্তাশক্তি বা সৃজনশীলতা বিবেচনায় আসে না। শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি এর অন্যতম প্রধান কারণ। আমাদের পাঠ্যক্রম এখনো মুখস্থনির্ভর। শিক্ষার্থীরা শেখে প্রশ্ন মুখস্থ করে উত্তর লেখা, শেখে না চিন্তা করা বা বিশ্লেষণ করা। ভর্তি পরীক্ষায়ও তাই চলে বই-নির্ভর তথ্য যুদ্ধ। জ্ঞানের প্রয়োগ বা বাস্তব দক্ষতার কোনো মূল্য নেই। কোচিং ও ব্যবসায়িক দৌরাত্ম্য ভর্তি পরীক্ষাকে প্রভাবিত করে। ভর্তি পরীক্ষা এখন কেবল শিক্ষা নয়, ব্যবসারও মাধ্যম। কোচিং সেন্টারগুলো বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করে। তাদের শেখানো টিপস বা শর্টকাটই যেন মেধার বিকল্প হয়ে উঠেছে। ফলে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা কিছুটা সুবিধা পায়, আর দরিদ্র মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ে। পারিবারিক ও সামাজিক চাপ শিক্ষার্থীদের ভেঙে পড়ার মূল কারণ। অনেক বাবা-মা সন্তানের মেধাকে নয়, বরং তাদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাকে মূল্য দেয়। এই চাপই শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। 

ভর্তি যুদ্ধের নামে চলা প্রাতিষ্ঠানিক ট্যাগের এই খেলা বন্ধের জন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। ভর্তি পরীক্ষাকে একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি না করে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়া গড়ে তোলা দরকার। বাস্তব জ্ঞান, যুক্তি, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীল চিন্তার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য কমাতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মানের সমতা আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সমান সুযোগ ও মর্যাদা দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কাউন্সেলিং সেন্টার গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা চাপের মধ্যে ভেঙে না পড়ে। কোচিং নির্ভরতা কমাতে হবে। কেননা ভর্তি কোচিংয়ের নামে যে ব্যবসা চলে সেখানে অনেক বাবা-মার গচ্ছিত মূলধন শেষ হয়ে যায়। অনেকাংশে দেখা যায় সন্তান কোথায় চান্সও পায় না। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরন এমন করতে হবে যাতে মুখস্থ নয় বরং চিন্তা ও বোঝার ক্ষমতা যাচাই করা যায়। তাতে কোচিংয়ের  প্রয়োজনীয়তাও কমে যাবে। অভিভাবক ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া জীবন নয়, জীবনের একটি ধাপ মাত্র। যে কেউ যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও সফল হতে পারে। সফলতা আসে পরিশ্রম ও দক্ষতা থেকে, কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে নয়। ভর্তি পরীক্ষা এখন আর জ্ঞানের পরিমাপ নয়, বরং একটি সামাজিক দৌড়। এই দৌড়ে টিকে থাকতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের হারিয়ে ফেলে। কেউ হারায় মানসিক শান্তি, কেউ হারায় আত্মবিশ্বাস, কেউ হারায় জীবনের অর্থই। আমাদের সমাজ এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে মেধা নয়, প্রতিষ্ঠানের নাম সবকিছু নির্ধারণ করে। অথচ একজন শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ুক না কেন, তার পরিশ্রম, সৃজনশীলতা আর সততাই তাকে সফল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আমাদের বুঝতে হবে, একজন ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও তার জ্ঞান কমে যায় না, বরং সমাজের দৃষ্টিই তাকে ছোট করে।

নুসরাত জাহান (স্মরনীকা)

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/146594