মৎস্য ও কৃষির ভান্ডার হাওড় অস্তিত্ব সংকটে! 

মৎস্য ও কৃষির ভান্ডার হাওড় অস্তিত্ব সংকটে! 

বাংলাদেশ প্রকৃতির অপার করুণা লাভ করেছে। নদীমাতৃক এই দেশ শুধু নদী নয়, জলাভূমিরও দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে অনন্য হলো হাওড় অঞ্চল; এক বিস্তৃত নিম্নভূমি। ‘হাওড়’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘হ্রদ’ বা ‘হ্রদয়’ শব্দ থেকে, যার অর্থ জলাশয় বা হ্রদ। এটি একটি মৌসুমি জলাভূমি যা বর্ষায় প্লাবিত থাকে আর শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে কৃষি জমিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড মতে সংখ্যাটি ৪১৪টি, অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা ৪২৩টি, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওড়, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হাওড়, গুরই হাওড়, ধনু হাওড়। বাংলাদেশের প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা হাওড় দ্বারা আচ্ছাদিত, দেশের মোট ভূমির প্রায় ৮.৮% এলাকা হাওড় ও জলাভূমি নিয়ে গঠিত। এই হাওড় অঞ্চল সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অংশজুড়ে বিস্তৃত। ভূতাত্ত্বিকভাবে এটি একটি নিম্নগঠিত অববাহিকা, যেখানে মেঘালয় ও আসামের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলোর পলিতে জমে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য জলজ ভূমি। হাওড় বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও জলজ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল। এখানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির পাখি (যার মধ্যে প্রায় ৫০ প্রজাতি পরিযায়ী), ৩০ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। 

বিশ্বখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওড় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ২০০০ সালে ইউনেস্কো টাঙ্গুয়া হাওড় কে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, অর্থাৎ এটি বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। এখানে প্রতিবছর রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি আসে শীতকালীন আশ্রয়ের খোঁজে। হাওড় মানে কেবল ফসল নয়, একটি বিশেষ জীবনযাপন ও সংস্কৃতি। এখানে মানুষ জলের সঙ্গে বসবাস করতে শিখেছে; জলে চলে, জলে মাছ ধরে, জলে গান গায়। হাওড়ের গান, বাউলদের দর্শন, নৌকাবাইচ, বর্ষা উৎসব সবকিছুই এই জলজ সংস্কৃতির প্রকাশ। লোকসংগীত গবেষকরা বলেন, লালন-দরবার, শাহ আবদুল করিম, রাধারমন দত্ত এই অঞ্চলের গানে হাওড়ের জীবন ও প্রকৃতি প্রবলভাবে প্রতিফলিত। হাওড়ের মানুষ প্রকৃতিকে শুধু ভোগ করেনি, তারা প্রকৃতিকে ভালোবেসে একে জীবনের অংশ করে নিয়েছে। আজ সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও হারিয়ে যাচ্ছে। যখন হাওড় শুকিয়ে যাচ্ছে, মানুষ শহরে পাড়ি দিচ্ছে, তখন হারিয়ে যাচ্ছে লোকগান, হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের জলজ কবিতা। বাংলাদেশের হাওড়গুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন -পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রকল্পের নামে হাওড় অঞ্চলে শতাধিক ছোট-বড় বাঁধ নির্মিত হয়েছে। এসব বাঁধ প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। বর্ষায় পানি আটকে বন্যা হয়, আর শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। নদী ও খালের মুখে বাঁধ নির্মাণের কারণে মাছের চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে।  

হাওড়ের খাল-বিল এখন বালু ও ইটভাটার দখলে। রাসায়নিক বর্জ্য, কীটনাশক, তেল, প্লাস্টিক বর্জ্য হাওড়ের জলজ প্রাণকে হত্যা করছে। অপরিকল্পিত সড়ক ও বাঁধ প্রকল্পে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, হাওড়ের ভেতরে তৈরি হচ্ছে ‘ডেড জোন’, যেখানে পানি স্থবির হয়ে যায় এবং অক্সিজেনের অভাবে মাছ মারা যায়। পাহাড়ি ঢল এখন সময়ের আগেই আসে। ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নেমে আসা হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় জনগণের মতামত বা প্রয়োজন প্রায় উপেক্ষিত। সরকার বিভিন্ন সময় হাওড় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ‘হাওড় উন্নয়ন নীতিমালা ২০১২’ থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ নেই। ফলে নীতির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল দেখা যায় না। একসময় হাওড়ের কৃষক বা জেলে মৌসুমি আয়ে জীবন চালাতেন। এখন অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হলে তারা ঋণে জর্জরিত হয়ে শহরমুখী হচ্ছে। ঢাকা, সিলেট বা ময়মনসিংহে ‘হাওড়বাসী শ্রমিক কলোনি’ এখন পরিচিত চিত্র। এরা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ রিকশাচালক। অর্থাৎ জলাভূমির সন্তানরা এখন কংক্রিটের জগতে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। সামাজিক প্রভাবও গভীর, হাওড়ের নারী সমাজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বর্ষায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চিকিৎসা পাওয়া কঠিন, সন্তান প্রসব বা জরুরি চিকিৎসায় অনেক প্রাণ হারায়। 

হাওড় রক্ষায় আমাদের বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেমন-একটি স্বাধীন ‘হাওড় সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে, যা পরিবেশ, পানি, কৃষি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কাজ করবে। অবৈধ বাঁধ ও দখল উচ্ছেদ করে নদী ও খাল পুনঃখনন করতে হবে। পানির স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে আনতে হবে। জলবায়ু সহনশীল ধান ও শস্য উৎপাদন, রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো, কৃষকের জন্য আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ, কৃত্রিম প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি, এবং পাখির আশ্রয়স্থল আইনত সুরক্ষিত করতে হবে। অসংযত পর্যটন এখন হাওড়ের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তাই ইকো-ট্যুরিজম ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে, যাতে স্থানীয় জনগণ উপকৃত হয়, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; এটি এক সভ্যতা, এক জীবনধারা। এখানে আকাশ আর জলের মিলনে মানুষ গড়ে তুলেছে সহনশীলতা, সংস্কৃতি ও মানবিকতা। কিন্তু আজ সেই সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। হাওড়ের মৃত্যু মানে কেবল কয়েকটি নদী শুকিয়ে যাওয়া নয়, বরং বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য ভেঙে পড়া। যদি এখনই সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে একদিন হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বইয়ের পাতায় পড়বে ‘বাংলাদেশে একসময় হাওড় নামে এক স্বপ্নীল জলাভূমি ছিল।’

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

 

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/146591