সুন্দরবন হোক ঝুঁকিমুক্ত

সুন্দরবন হোক ঝুঁকিমুক্ত

বাংলাদেশ প্রকৃতির বৈভবে ঋদ্ধ হলেও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আমাদের সংবেদনশীলতার অভাব অত্যন্ত প্রকট। আমরা প্রতিনিয়ত বনজঙ্গল ধ্বংস করছি : নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর মরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে চলেছি। উপলব্ধি করছি না যে এই প্রক্রিয়া আমাদের অস্তিত্বের জন্যই বড় হুমকি। প্রকৃতির সঙ্গে এমন অবিমৃশ্যকারী আচরণ বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের অপরিণামদর্শিতা থেকে রেহাই পায়নি অপূর্ব সুন্দরবনও।

পৃথিবীর অন্যতম বিরল প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের ওপর উপদ্রবের শেষ নেই। পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য সংকট, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বনসংলগ্ন অঞ্চলে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও চোরাশিকারির দৌরাত্ম্যে সুন্দরবন আজ বিপন্ন।

হিমালয় থেকে সুন্দরবন-এর এই বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরেই ‘জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।’ এদেশ কখনো বন্যায় ভাসে। কখনো শহর বন্দর গ্রাম চুরমার হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় -জলোচ্ছ্বাসে। প্রাকৃতিক তান্ডবের সঙ্গে এদেশের মানুষের এ লড়াই যেমন সত্য, তেমনি সত্য গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার মিলিত অববাহিকাজুড়ে শস্য-শ্যামলা-সুফলা বাংলাদেশের অপরূপা প্রকৃতির অনন্য দান। নদীর একূল ভেঙে ওকূল গড়ার মতো শত সহস্র বছর ধরে প্রকৃতি নিজেই নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে আগলে রেখেছে বাংলাদেশকে। কিন্তু শিল্প বিপ্লব উত্তর আধুনিক নগরসভ্যতায় প্রকৃতি ধ্বংসের আত্মঘাতী দখল-দূষণে পৃথিবী আজ বিপন্ন।

নদী-জল-বন-বাদাড়-হাওড়-বাওড়ের অনন্য প্রকৃতি নিয়ে সাগরমুখে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের আজ এই আসন্ন বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। বরং আরও স্পষ্টভাবে এই সত্যটা সামনে আনা জরুরি যে, প্রবল শিল্পায়নে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমনে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির একটি আমাদের এই নদীমাতৃক-সমুদ্র মাতৃক বাংলাদেশ।

আবার আগুন লাগার ঘটনাও ঘটে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বনে প্রায় প্রতি বছরই আগুনের ঘটনা ঘটছে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৪ বছরে অন্তত ৪০ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। প্রায় পাঁচ একর এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ছড়িয়েছিল বলে বন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। সুন্দরবনে এ পর্যন্ত প্রতিটি আগুনের ঘটনা ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। এর আগে ২০২১ সালে চাঁদপাই রেঞ্জে দুইবার আগুন লেগেছিল।

অতীতের আগুনের ঘটনায় প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হলেও তাদের প্রতিবেদনের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আগের তদন্ত কমিটিগুলোর বেশির ভাগ প্রতিবেদনই আগুন লাগার কারণ হিসাবে মৌয়ালদের ব্যবহৃত আগুনের কুন্ডলী, জেলেদের সিগারেট, গ্রীষ্মের দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক কাজ ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। মাটিতে জমা হওয়া শুকনা পাতার পুরু স্তর আগুন ছড়িয়ে পড়তে ও দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করে।

অসাধারণ জীববৈচিত্র্য এবং মিঠাপানি ও নোনাপানির অনন্য বাস্তুসংস্থানের মিলিত আধার হওয়ার কারণেই সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকো। কিন্তু এখন পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবনকে নিয়ে শঙ্কিত তারাও।

ইউনেসকো সুন্দরবনের যেসব ঝুঁকির কথা বলছে তার মধ্যে রয়েছে- উজানের নদীগুলো থেকে প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে মিঠাপানির স্বল্পতা ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে পশুর নদ খনন, বন্যপ্রাণী শিকার, ভূমিক্ষয় ও ভাঙন, বনের ভেতর নানা অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ, বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নানা রকম কলকারখানা স্থাপন এবং এসব নানা উৎসের কারণে মারাত্মক পানি দূষণ।

একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ নদীগুলোতে পলি বেড়ে গিয়ে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বসতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক উদ্ভিদ উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে না পেরে মারা যাচ্ছে। একই সঙ্গে এ কথাও আমাদের ভাবতে হবে যে, বারবার ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোন ঠেকিয়ে দিয়ে সুন্দরবন আমাদের যা শেখাচ্ছে, শিখছে কি তা বাংলাদেশ। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে কাজ শুরু করতে হবে।

পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/146556