বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় শীতের আগমনে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে তাঁত পল্লী
দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি : প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। এই শীতের আগমনে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে উপজেলার বিভিন্ন তাঁত পল্লী। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার তাঁত পল্লীর নারী-পুরুষরা তাদের বিভিন্ন পণ্য তৈরির পাশাপাশি শীতের উলেন চাদর তৈরীর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভোর থেকে গভীররাত পর্যন্ত তাঁতে খটখটি শব্দে তাঁত পল্লী এলাকা এখন মুখরিত।
গতকাল শুক্রবার উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ফুটানিগঞ্জ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এই গ্রামের নব্বই শতাংশ পরিবারই তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত। তারা দারিদ্রতা ঘোঁচাতে তাঁত শিল্পের সাথে নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছে।
তাঁত কারিগর আফরোজা বেগম, লুৎফুর রহমান, সোহরাব হোসেন, মিনহাজসহ অনেকেই জানান, আজকাল অনেকেই তাদের পুরানো পেশা ছেড়ে গেলেও এই ব্যবসাটি একটু লাভ জনক হওয়ায় এই গ্রামে আগের চেয়ে বেশি মানুষ তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত হচ্ছে। এই তাঁতশিল্প ঘুড়িয়ে দিচ্ছে অনেকের ভাগ্যের চাকা। আগের দিনের পুরানো হ্যান্ডলুম মেশিন অনেকে ব্যবহার করলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর্থিক স্বচ্ছলতায় কেউ কেউ পাওয়ার লুম মেশিন কিনেছেন।
তারা আরো জানান, মান্ধাতা আমলে হাত দ্বারা পরিচালিত পুরানো হ্যান্ডলুম মেশিন ব্যবহার করে দিনে ৭ থেকে ৮টি চাদর তৈরি করা যেত। এখন বিদ্যুৎ চালিত আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে ১০গুন পন্য তৈরি বেড়ে গেছে। তবে অনেকের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় আধুনিক পাওয়ার লুম মেশিন কিনতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন। তাদের দাবি সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে এই তাঁত শিল্পে কাঙ্খিত সাফল্য বয়ে নিয়ে আসত।
তাঁতপল্লীর কারিগর শেফালি বেগম জানান, বিয়ের পর থেকে তার জীবনের আর্থিক দূরদশা কাটছিল না। বাস করতেন পরের জায়গায়। আস্তে আস্তে ছোট পরিসরে তাঁতশিল্পের কাজ শুরু করেন। প্রথমে হ্যান্ড লুমের সাহায্যে চাঁদর বুনিয়ে বেশ কিছু টাকা আয় করেন। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। পুরোদস্তর একজন তাঁত কারিগর হয়ে গড়ে উঠেন। আগে অন্যের বসত ভিটায় বসবাস করলেও আয়ের টাকায় গ্রামেই জায়গা কিনে গড়েছেন নিজস্ব বাড়ি। দুটি আধুনিক পাওয়ার লুম মেশিন ক্রয় করে বাড়িতেই বসিয়ে যেন ছোট খাটো কারখানা গড়ে তুলেছেন।
এখনও আরো বদলে যাওয়ার বিভোর স্বপ্ন দেখছেন। ফুটানিগঞ্জের গ্রামের নারী-পুরুষ কারো যেন এতটুকু সময় নেই গামছা, লুঙ্গি তৈরির পাশাপাশি শীতের আগমনকে কেন্দ্র করে রঙ বেরঙের চাদর তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। ফুটানীগঞ্জ তাঁতপল্লির মানুষদের প্রত্যাশা গ্রামের যাতায়াতের একমাত্র মাটির রাস্তাটি পাকা করনের মাধ্যমে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টিকরনসহ সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে ফুটানিগঞ্জ গ্রামটি তাঁত শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত আর্থিক স্বচ্ছলতায় একটি সমৃদ্ধশালী পল্লী এলাকা হয়ে উঠবে।
উপজেলার ফুটানীগঞ্জ ছাড়াও তাঁত পল্লী এলাকা হিসাবে পরিচিত, তালোড়ার নওদাপাড়া, দেবখন্ড, সাবলা, সানাপাড়া, কইল, ডাকাহার, জিয়ানগরের ভেঁপড়া, বারাহী, বাঁকপালসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। প্রতিটি গ্রামেই শীতের আগমন উপলক্ষে নারীদের উলের চাদর তৈরিসহ বেচাকেনা প্রচুর ধুম পড়ে গেছে। তাঁত পল্লীর প্রত্যেক বাড়িতেই তাঁতের খটখটি শব্দে পুরো এলাকা এখন মুখোরিত।
এসব চাদরের প্রধান উপকরণ উলের সুতা। যা তারা পার্শ্ববর্তী আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল হাট থেকে কিনে আনেন। চাঁদর তৈরির ক্রয়কৃত সুতা প্রথমে লাটাইয়ে তুলতে হয়। তারপর চরকায় নলি গেঁথে গাছ বা খুঁটির সাথে তানা (আঞ্চলিক শব্দ) কারান হয়। তারপর পাইপ বা লম্বা কাঠের গুড়িতে পেঁচিয়ে তাঁতে দিয়ে চাদরসহ বিভিন্ন ধরনের পন্য তৈরি করা হয়। তৈরীকৃত চাদরের বেশিভাগ ওই হাটে বিক্রি করে থাকে। ১ কেজি উলের সুতার দাম ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। এ সুতায় তিনটি চাদর হয়। তিনটি চাদরের পাইকারী বিক্রয় মূল্য প্রকারভেদে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা।
এছাড়াও উপজেলা সদরের ধাপসুলতানগঞ্জ হাট, তালোড়া হাট, সাহারপুকুর হাট, চৌমুহনী হাট, তালুচহাট, জিয়ানগর হাটসহ অনেকে গ্রামে ফেরি করে তাদের তৈরীকৃত এই চাদর বিক্রি করেন। এ ব্যবসা আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাস পর্যন্ত খুব ভাল চলে। দেশের বিভিন্ন স্থানের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশী হয় এবং বাজারে অন্যান্য চাদরের তুলনায় তাদের তৈরীকৃত চাদরের মুল্য তুলনামূলক কম হওয়ায় এর চাহিদাও থাকে বেশি। ফলে এ কয়েকমাস তাঁত পল্লী এলাকার নারী পুরুষ সহ ছেলে মেয়েরাও চাদর তৈরীতে ব্যস্ত থাকে। সংসারের কাজের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এ ব্যবসা করে আর্থিকভাবে তারা লাভবানও হয়েছে এবং সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করছে।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/146538