জয়পুরহাটের পাঁচবিবির ৭০ পরিবারের জীবন চলে ইটের খোয়া ভেঙে
পাঁচবিবি (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি : সেই কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার কাজ। ঠুকঠাক, ধুপধাপ শব্দে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের প্রতিদিনই জীবিকার তাগিদে এমন কর্মে মগ্ন থাকতে হয় সারাক্ষণ। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি পৌরসভা শহরের পাঁচমাথা হতে স্টেশন সড়কের পাঁচবিবি লাল বিহারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্টেশন পর্যন্ত কুলিপট্টি এলাকায়। এই সড়কে চলাচলকারী পথচারীদের কানে রাস্তার দু’পাশ থেকে ভেসে আসে এমন শব্দ।
এ শব্দ নিছক একটি শব্দ নয়, এটি একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামের। এটি পাঁচবিবি পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের অর্ন্তভুক্ত। এই কলোনিতে বসবাসকারীরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সিং সম্প্রদায়ের অনুগত। যাদের সকলেই ভূমিহীন দরিদ্র।
এদের আদি পুরুষেরা বৃটিশ শাসনামলের শেষ দিকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে পাঁচবিবি স্টেশনে কুলি শ্রমিকের কাজ করতো। কুলি শ্রমিকের কাজ শেষে নিজেরা থাকার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রেলওয়ের পাশেই বসতি গড়ে তোলে। শুরুতে গুটিকয়েক পরিবার হলেও এখন তা বেড়ে প্রায় ৮৬টি পরিবার হয়েছে। এরা পরিবার-পরিজন নিয়ে গাদাগাদি করে বাস করে টিনের ছাপড়ার ছোট ছোট ঘরে। বর্তমানে এলাকাটি কুলিপট্টি বা তুড়িপট্টি নামেও পরিচিত।
মূলত এদের আদি পেশা কুলি হলেও এখন সড়ক পথে ট্রেনে মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ায় পাঁচবিবি রেলওয়ে স্টেশনে আগের মত আর মালামাল উঠানামা করে না। এতে করে বেশিরভাগ কুলি কর্মহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জীবন ধারনের জন্য অনেকেই পেশা বদলিয়ে অটোরিকশা বা ভ্যান চালিয়ে, রঙ মিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কাজ করে। বাঁচার সংগ্রামে এদের অনেক পরিবারের মহিলারা বেছে নেয় ইট ভেঙে খোয়া তৈরির কাজ।
শুরুতে কয়েকজন হলেও এখন নানা বয়সী পুরুষ-মহিলা মিলে প্রায় ৭২টি পরিবার একাজে জড়িয়ে পড়েছে। আগে পুরাতন ভবনের পরিত্যক্ত ইট কিনে খোয়া করে বিক্রি করলেও এখন বিভিন্ন ইটভাটা থেকে টুকরো ইট কিনে খোয়া তৈরি করছে তারা। এসব খোয়া বিভিন্ন মানের। স্বচ্ছল ও নিম্ন আয়ের সব শ্রেণিরর মানুষ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন কিনে এসব খোয়া।
ছোট ছোট প্রতি ডালি (টুকরি) খোয়ার দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। এ আয় দিয়ে তারা পরিবারের ভরণ-পোষণ, ঋণের কিস্তি আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালায়। তবে স্বচ্ছলতা নেই কারো, তারপরও জীবন থেমে নেই। নেই শিক্ষার আলো। তবে ইদানিং কিছু সচেতন মা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠান। নেই কোন শৌচাগার। এমন সংগ্রামী জীবন নিয়ে তাদের রয়েছে হতাশার অভিব্যক্তি।
বিধবা সারথী রানি (৭৮), গৃহবধূ মিনু (৪০), রঙ মিস্ত্রি সুমনের স্ত্রী ঝুমুর (৩০), দেবদাস (৪৫), বুলো (৫২ ), গৌড় (৭৫), মিনতি (৬৫) ও মরিয়ম (৭০) সবার প্রায় একই কথা। তারা বলেন, আগে ভাটায় ইটের দাম কম ছিল এখন বেশি হওয়াতে আগের মতো লাভ হয় না।
তারপরও জীবনের প্রয়োজনে এসব করতে হচ্ছে। এদিকে স্কুলের সীমানা প্রাচীরের বাইরে যারা খোয়া ভাঙে মাঝে মাঝে তাদেরকে কর্তৃপক্ষ ওই স্থান থেকে সরে যেত বলে। কিন্তু তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। ভোটের সময় এদের কদর আর আশ্বাস থাকলেও অন্য সময় থাকে অবহলা। এদের নেই কোন সংগঠন। এ পেশায় জড়িতরা নিজের পরিবর্তনে চায় সরকারি সহায়তা।
পোস্ট লিংক : https://www.dailykaratoa.com/article/145983